In search of Fataruu's in corona days | Adamas University

In search of Fataruu’s in corona days

Bengali Literature, Covid-19

In search of Fataruu’s in corona days

করোনার দিনগুলিতে ফ্যাতারুদের সন্ধানে

বইয়ের তাকে জ্বলজ্বল করছিল বইটা। নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘উপন্যাস সমগ্র’। দে’জ পাবলিশারের বই। নবারুণ ভট্টাচার্য আমার প্রিয় সাহিত্যিকদের একজন। অনেকেরই প্রিয়। ইতিমধ্যেই তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস  পড়া হয়ে গেছে। হারবার্ট  নামের উপন্যাসটি পড়েছিলাম সেই ছাত্রজীবনে। তখন থেকেই নবারুণ ঘোর ধরিয়ে দেয় মাথায় ।

সেই ঘোর বোধহয় এখনও কাটেনি। তারপর ফ্যাতাড়ু সিরিজের সেইসব অবিশ্বাস্য গল্প। স্বভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ফ্যাতাড়ুরা তখন কলেজ স্ট্রিটের মূল চর্চার বিষয়। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে চলেছে পুরন্দর ভাটের সেইসব কবিতা। সংসৃতি নাট্যদল মঞ্চস্থও করেছিল ফ্যাতাড়ু। মনে আছে একবার দেখে সাধ মেটেনি। পরে সুমন মুখোপাধ্যায় হারবার্ট সিনেমাও বানিয়েছিলেন। শুভাষিস মুখোপাধ্যায় হারবার্ট চরিত্রে বোধহয় জীবনের সেরা অভিনয়টি করেছিলেন।

  • তারপর এলো ‘কাঙাল মালসাট’। বিগত কয়েক দশকে এই ধরণের কোনও উপন্যাস লেখা হয়েছে কি বাঙলা সাহিত্যে? কিংবা এতো তুমুল আলোড়ন ও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে কি আর কোনও লেখা? খুব একটা কিছু মনে আসছে না। বাঙালির সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভণ্ডামির এতো নিপুণ পরিচয় এবং সেগুলিকে এভাবে ধরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী লেখক নবারুণ ছাড়া কয়জনই বা আছেন। কাঙাল মালসাটও সিনেমা হয়ে বেরোয়। এতো বহুস্তরীয় বর্ণণাভঙ্গিকে সিনেমার রিলে ফুটিয়ে তোলার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন আবার সেই সুমন মুখোপাধ্যায়। এরপর ইতস্তত পড়েছি যুদ্ধ পরিস্থিতি, লুব্ধক ইত্যাদি উপন্যাসও । অনেকদিন থেকেই মাথায় ঘুরছিল নবারুণের সব কটা উপন্যাস যদি একটানা পড়ে ফেলা যায়! কিন্তু দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে সেই অবকাশ খুব একটা ছিল না।
  • এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে গৃহস্থালির কাজকর্ম সেরে, ছয় বছরের ছোট্ট ছেলের নানা আবদার মিটিয়ে, ইউনিভার্সিটির অনলাইন কর্মযজ্ঞের শরিক হওয়ার পরেও তাই নবারুণের উপন্যাস সমগ্র হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। কিছুদিন আগেই কিনে আনা সেই বই ইতিমধ্যেই নাড়াচাড়া করে নিয়েছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু নবারুণ তো আর সহজপাঠ্য আর সহজপাচ্য কোনও বিষয় নয়। কিংবা ভাতের হাঁড়িও নয় যে একটা চাল টিপেই সব ভাতের ভিতরের খবর জেনে নেওয়া যাবে! কাজেই ডুব দেওয়াই মনস্থির করলাম।
  • একে একে আবার পড়ে ফেললাম হার্বাট, ভোগী, যুদ্ধপরিস্থিতি, খেলনা নগর, কাঙাল মালসাট, লুব্ধক, অটো, মসোলিয়ম। পড়ছিলাম আর বোঝার চেষ্টা করছিলাম নবারুণ আসলে কাদের কথা বলেন? কাদের প্রতি তার সমর্থন?
  • উপন্যাসে উপন্যাসে আসলে তিনি তুলে ধরছেন বহুদিন ধরে বঞ্চিত, বহুদিন ধরে ব্যবহৃত কিছু মানুষের কথা। না শুধু তাদের বঞ্চনার কথা নয়, হতাশার কথা নয়, সেইসঙ্গে সেই মানুষগুলো , দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া মানুষগুলো পালটা ষড়যন্ত্রে সামিল হচ্ছে অবশেষে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে, এই হিপোক্রাসির বিরুদ্ধে, মধ্যবিত্তের এই শান্ত শিষ্ট নাদুস-নুদুস নিরপেক্ষ সুযোগলোভী অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, উচ্চবিত্তের আর ক্ষমতাবানের বিশ্বাসঘাতকার বিরুদ্ধে, ইতিহাসের পাতায় নিজেদের অনুল্লেখের রাজনীতির বিরুদ্ধে।
  • কাঙাল মালসাট উপন্যাসে যেমন ফ্যাতাড়ু আর চোক্তারেরা মিলে ঘনিয়ে তোলে এক সশস্ত্র বিদ্রোহ। পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রযন্ত্রই আসলে কোনওদিনই জানতে পারবে না সেই ভিতরে ভিতরে ঘনিয়ে ওঠা বজ্রগর্ভ মেঘের খবর। বৃহৎ সিস্টেমের বিরুদ্ধে জং ধরা দুটো তলোয়ার, হাতা, খন্তি, লাঠি কিংবা পর্তুগিজ আমলের মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা একটা নুনু-কামান নিয়ে সেই অসম যুদ্ধে চোক্তার আর ফ্যাতাড়ুরা নেমেছে হাসতে হাসতে, কার্নিভালের মেজাজে। ভাবছিলাম, করোনা ভাইরাসের এই সর্বগ্রাসী পরিস্থিতি যদি বেঁচে থাকতেন এখনো নবারুণ কেমন করে ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর লেখায়?
  • ভাবছিলাম আর আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কেই আন্দাজ করতে পারছিলাম কী অসম্ভব এক আখ্যান তৈরি করে দিতেন নবারুণ তার কলমের আঁচড়ে।
  • এই ভাইরাস-সংক্রমণ-কে কি চোখে দেখতেন তিনি? কিভাবে নির্মাণ করতেন এক যাদু-বাস্তবতা –যা আসলে বাস্তবেরই এক নিষ্করুণ চেহারা মাত্র। এখনও আমরা নিশ্চিত নোই কিভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি – তা কি প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট নাকি মানুষের বিজয়াকঙ্ক্ষার এক নির্মম পরিণতি।
  • এই আবছায়ার সুযোগ নিয়ে হয়তো তিনি দেখাতেন এই ভাইরাস আসলে ফ্যাতাড়ূ আর চোক্তারদের দীর্ঘকালব্যাপী সযত্নলালিত এক নাশকতার পরিকল্পনার রূপায়ণ মাত্র। মানুষ নামক অহঙ্কারী (তাই পতনোন্মুখ) জীবটির মুখে এ এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। এই দেখ তোমার লোভ, তোমার জয়ের আকঙ্খা, পৃথিবীর সব খাদ্য আর সব সব সম্পদে নিজের আধিপত্য স্থাপনের ইচ্ছায় ভরপুর তোমার অন্ধকার অবচেতন – আজ তোমায় কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে।
  • তারপর আবার ভাবি, সত্যিই কি নবারুণ দেখাতেন এই নাশকতা? তিনি তো চিরদিন সেইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হয়ে কথা বলেছেন। এই ভাইরাস-যুদ্ধে সেই মানুষরাই হয়তো এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী আমরা কিংবা উচ্চবিত্তরা তো এখনও দুবেলা ভালোমন্দ খেয়ে, ডালগোনা কফি কিংবা ছোটবেলার হামাগুড়ি দেওয়া ছবি আপলোড করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। নবারুণ হয়তো সেই মানুষদের হয়ে নির্মাণ করতেন কোনও আখ্যান যারা রুজি-রুটি হারিয়ে অনিশ্চিত বর্তমান ও আরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমি তাকিয়ে থাকি ছবিটার দিকে।
  • কিছুদিন আগেই সব খবরের কাগজে বেরিয়েছিল এমন এক ছবি। একদল মানুষ মিছিলের মতো চলেছে। সংঘবদ্ধ মিছিল নয়; ছত্রখান হয়ে যাওয়া মিছিল-যারা জানে কোথায় পৌঁছাতে হবে অথচ পৌঁছানো যাবে কি না যাদের জানা নেই। দেখতে ছিন্নমূল মানুষের মতো লাগছে ওদের। তাড়াহুড়োয় যেটুকু সম্বল গুছিয়ে নিয়েছে নাইলনের ব্যাগে কিংবা সিমেন্টের থলিতে কিংবা রেক্সিনের লম্বা ব্যাগে। যানবাহনহীন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে সবাই। কারও কাঁধে বাচ্ছা, কারও কোলে। কোনও কোনও বাচ্ছা পাল্লা দিয়ে হাঁটছে মা-বাবার সঙ্গে। হয়তো আরও হাঁটতে হবে- পঞ্চাশ মাইল কিংবা একশো মাইল বা আরও বেশি। একজীবনে মানুষকে অনেক অনেক হাঁটতে হয়। এই সত্যটাকে সহ্য করতে পারতেন কি নবারুণ ? তার ফ্যাতাড়ুরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদে এগিয়ে আসতো? পুরন্দর ভাটের কবিতা নিশ্চই খাদ্য, জল, আশ্রয়ের নিরাপত্তায় মোড়া আমাদের শান্তির গৃহকোণকে ব্যঙ্গ করতো।
  • না কি তিনি নির্মাণ করতেন এমন কোনও আখ্যান যা তিনি নির্মাণ করেছেন ‘ভোগী’ উপন্যাসে। এই সংকটে পরিত্রাণ হিসাবে এগিয়ে আসবে ভোগীর মতো কেউ। মানব সভ্যতায় এমন এক সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে, মানুষকে বাঁচাতে, মানুষের কল্যাণের জন্য নির্মোহ ভাবে যখন ভোগী নিজেকে উৎসর্গ করবে মৃত্যুর কাছে। তার সেই স্যাক্রিফাইস আবার পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলবে এই নিশ্চিত বিশ্বাসে সে হাসতে হাসতে মরে যাবে।

জানি, নবারুণ তার পূর্বের কোনও লেখারই অনুবর্তন করতেন না এই পরিস্থিতিতে।  সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনবেদ রচিত হত তার হাতে। কিন্তু ঠিক জানি, তিনি কলম ধরতেন এই পরিস্থিতিতে সবকিছু হারাতে বসা মানুষগুলোর জন্যই। যে মানুষগুলোর পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোই এখন আমাদের একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে হয়।   

Visited 904 times, 1 Visit today

Skip to content