ব্যবধানের চলচ্চিত্র

ব্যবধানের চলচ্চিত্র

ধীরে ধীরে উঠছে লকডাউন। শুরু হয়েছে ‘আনলক 1’। তবু অন্য অনেক কিছুর মতোই সিনেমাহল বন্ধ। কবে খুলবে, তার একটা আভাস মিললেও, কবে জনসমাগম হবে… বোঝা যাচ্ছে না। অনেক শিল্পী কাজ হারিয়েছেন, তারকারাও কাজের জীবনে ফিরতে না পারায় ম্লান। বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সিনেমাহলের পাশে একইরকম খাঁ খাঁ করছে মাল্টিপ্লেক্স। সপ্তাহান্তের ভিড়ে উপচে উঠছে না কাউন্টার। রুপোলি পর্দা তার দ্যুতি হারিয়ে স্থির।

কিন্তু তা বলে কি মানুষের সিনেমা দেখায় ভাঁটা পড়েছে? মোটেই না। যার যার মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপে ঠাসা ফিল্ম লাইব্রেরি কতটা সঙ্গ দিচ্ছে একার জীবনে, ফেসবুক খুললেই বোঝা যাচ্ছে। নিত্যনতুন সিনেমা, সিরিজের আলোচনায় মুখর যুবসমাজ। তাহলে, বিনোদনের চাহিদা কমেনি, জোগানও নয়। বিনোদন স্রেফ মাধ্যম পাল্টেছে। আর এই পথ ধরেই বদলে যেতে চলেছে বিনোদনের আঙ্গিক।

যে সমস্ত চলচ্চিত্র ‘হিট’, ‘বক্স অফিসে সাফল্য’ আনে, তাদের অধিকাংশই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। সেখানে বিরাট পর্দায় বিরাট হয়ে দেখা দেন নায়ক, পর্দায় আগুন ধরিয়ে দেন রূপসী নায়িকা। এক-একটা action দৃশ্যে উড়ে যায় গাড়ি, দশ-বারোজন গুন্ডা। প্রেম আসে বিদেশের বিস্তৃত সুরম্য ল্যান্ডস্কেপে, হলের স্পিকারে গমগম করে ওঠে গান। গায়ে কাঁটা দেয় সকলের, যখন রহস্যের উন্মোচন ঘটে। চোখে জল ঝিলমিল করে সবার, যখন বিচার পায় শোষিত। সকলে একসঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে যখন নায়কের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চোখ নামায় নায়িকা। বাহুবলী-দেবসেনার যৌথ লড়াই, কিং খানের দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো, জোকারের শেষ দৃশ্যে নৈরাজ্যের কার্নিভাল, ‘Avengers, assemble’-এর উদাত্ত আবাহন – সমস্ত দর্শকের হলভর্তি প্রতিক্রিয়া নিয়ে অধিকতর সত্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু আজ, যখন পর্দায় কিচ্ছু নেই, তখন কী নিয়ে থাকবে দর্শক? অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি ওয়েবিনারে সাহিত্যিক সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় এরকমই একটা প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘কন্টেন্ট’। এখানেই লুকিয়ে আছে লকডাউন পরবর্তী সিনেমা জগতের মূল সূত্র। মানুষ এখন হাতের মুঠোয় কিংবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা-সিরিজ দেখতে শিখেছে। তার কানে ইয়ারফোন। সে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সময়ে সে আর গ্ল্যামার চায় না, জাঁকজমক চায় না। এখন তার প্রয়োজন, একটা ভাল গল্প। নায়কের পেশী বা নায়িকার সৌন্দর্য যখন ছোট ফ্রেমে সীমাবদ্ধ, তখন তা দিয়ে আর তেমন বিভ্রম তৈরি করা যাবে না। ফলে এবার মানুষ অভিনয় দেখবে। দেখবে ‘স্টোরিটেলিং’। দেখবে প্রতিটি শট, আলোর কাজ। তীক্ষ্ণতর কান নিয়ে শুনবে সংলাপ। মন দিয়ে যাচাই করবে, কোথায় যাচ্ছে গল্প। এখন আর তাকে ভোলানো তত সহজ নয়।

পাশাপাশি, এই সময়ে প্রাধান্য পাচ্ছে গল্পে থাকা সূক্ষ্মতর সংবেদন। একজন দর্শকের নীরবতা, চোখ ভিজে আসা, চাপা কষ্ট, আনন্দে মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠা, উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠা – এগুলো এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোটাদাগের হাসিকান্না নয়, এখন স্ক্রিপ্টের শক্তি মানুষের মর্মস্থল স্পর্শ করা। সেইমতো লেখা হচ্ছে গল্প। যেসব সিনেমা বা সিরিজে এইসব উপাদান ছিল, কিন্তু চর্চিত হয়নি – তাদের ফিরিয়ে আনছে মানুষ। ওয়েব পোর্টাল, ওটিটি, ইউটিউব, ডাউনলোডিং সাইট ঘেঁটে। নিজস্ব প্রতিক্রিয়াকে আলোচনায় ফেলছে, মিলিয়ে নিচ্ছে অন্যের সঙ্গে।

একদিন সিনেমাহল খুলবে ঠিকই। ফের রুপোলি পর্দা ঝলমলাবে, হাউজফুল হলে বেজে উঠবে প্রোডাকশন হাউজের শীর্ষসংগীত। কিন্তু মানুষের রুচি ততদিনে সূক্ষ্মতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ঘরমুখী মানুষ, একটি কোণে কুশন পেতে ‘নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল’ প্রজন্মের মানুষকে যদি হলে ফেরাতে হয় – তাদের যোগ্য সিনেমা প্রয়োজন। তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে আবেগে উদ্বেলিত করতে পারে, এমন গল্প, সংলাপ, অভিনয়, ক্যামেরার কাজ প্রয়োজন। না হলে এই খরা কাটিয়ে সিনেমাশিল্প আগের শক্ত মাটি ফিরে পাবে না।

যে কোনও অসময়ের পর মানুষ কিছুটা সময়ের জন্য প্রখর বাস্তববাদী হয়। সে জানে কোনও হিরো তাকে অসুখ থেকে বাঁচাতে আসেনি। সে জানে কারফিউর মধ্যে বেরিয়ে পুলিশের লাঠি খেলে হিরোইনের চোখের রং তাকে সান্ত্বনা দেবে না। সে জানে এখন সত্যিকারের নায়ক-নায়িকারা হাসপাতালে, আপৎকালীন পরিষেবায় ব্যস্ত। সে জানে, কোন গল্প জীবনের। এখন বহুদিন মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখবে না। একটা মানবিক, সংবেদনশীল, মায়ায় ঘেরা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখবে। আগামীর চলচ্চিত্রকারদের কাজ সেই স্বপ্নকে অবয়ব দেওয়া। যদি তাঁরা পারেন, তাহলে একদিন ফের উপচে উঠবে হল। একদিন ফের ‘কী খালি মোবাইল দেখিস, চল সিনেমা দেখে আসি’-র আবদার ফিরে আসবে। একদিন ফের স্ক্রিপ্ট পড়ে আমাদের প্রিয় তারকাদের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠবে।

আশা রাখি, ঘুরে দাঁড়াবে চলচ্চিত্র শিল্প। সময়ের সমস্ত সংকেত সঠিকভাবে পড়তে পড়তে। কারণ, অন্ধকারের পর আলো খুঁজে পাওয়া ছাড়া আমাদের গতি নেই।

Online Education and the Future of Books

বৈদ্যুতিন পড়াশোনা ও বইয়ের ভবিষ্যৎ

চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। সামনে তেমন আশাপ্রদ কিছু নেই। তবু, ঠিক সামলে নেওয়া যাবে, এই ভরসা রেখে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসের বুদ্বুদ মাঝে মাঝেই ফেটে যাচ্ছে… যখন কর্মক্ষেত্রে একের পর এক আনকোরা সমস্যা এসে দেখা দিচ্ছে। আমরা যারা সাহিত্য পড়াই, তাদের কাছে এক নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে – বইয়ের অভাব।

সাহিত্যের পড়াশোনা চিরকালই বিভিন্ন বিচিত্র ধরনের পাঠ-অভ্যাসের ওপর দাঁড়িয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই, বইয়ের দোকানে গিয়ে কে কত দুষ্প্রাপ্য বই খুঁজে বার করতে পারে, তা আমাদের প্রিয়তম বিনোদন। বইয়ের খবর রাখা, কেনা, পড়ে ফেলা, উৎসাহ পেলে সে বিষয়ে আরও বই জোগাড় করা, লেখকদের তত্ত্বের তুল্যমূল্য বিচার – এ সবই আমাদের চর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাহিত্যের ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে বই নিয়ে। আজ বই-ব্যবসায় বিরাট ধ্বস নেমেছে।

আজ প্রেস বন্ধ, অক্ষরকর্মীদের কাজ নেই, বইপাড়া খাঁ খাঁ করছে। কোনও অজ্ঞাত কারণে বই আমাদের ‘এসেনশিয়ালস’ হয়ে উঠতে পারেনি আজও, তাই বিভিন্ন শহরে বইয়ের দোকান বন্ধ। আমাদের পড়ানোর সম্বল বলতে নিজস্ব পুঁজি থেকে ছবি তুলে পাঠানো এবং পিডিএফ খুঁজে দেওয়া।

ছবি তুলে পাঠানোয় অসুবিধা কিছু নেই। কিন্তু সীমিত সময়ে, সীমিত বিষয়ের ছবিতোলা পৃষ্ঠা পড়ে কতটুকু সম্যক জ্ঞান লাভ হয় একজন ছাত্রের? একটি বইয়ের ভূমিকা, এমনকি উৎসর্গপত্র পর্যন্ত আমাদের জানতে হয়। কারণ শুধু বইয়ের শরীর নয় – একজন সাহিত্যিক বা তাত্ত্বিক তাঁর বইয়ের সর্বাঙ্গে থাকেন। বহু কথা বলে দেয় প্রচ্ছদ। সূচিপত্র সাজানোর ধরন। পাদটীকায় সরস টিপ্পনী আমাদের পৌঁছে দেয় তাঁর কাছাকাছি। বারবার পড়তে পড়তে আচমকা নতুন কোনও এক বোধে উন্নীত হওয়া, তার জন্য একটা বইয়ের সঙ্গে যাপন করতে হয় অনেকগুলো দিন। বইয়ের সঙ্গে সেই ‘ফিজিক্যাল’ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা।

পিডিএফ-এও সেই সমস্যা থাকে। তাছাড়াও – প্রথমত বাংলা বইয়ের পিডিএফ খুব কম হয়। যা পাওয়া যায় তা একটি-দুটি সাইটে। এখন, পিডিএফ মাত্রই বিনামূল্যে পাওয়া যাবে এরকম একটা ধারণা অল্পবয়সিদের রয়েছে। ‘বিনামূল্যে সিনেমা, গেম, app যখন পাওয়া যাচ্ছে – তখন বই কেন দাম দিয়ে কিনব?’ এই ভাবনা থেকে অনেকেই বই অনলাইন কিনতে চাইছে না। আর এই চাহিদার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মূল্যবান, নতুন বইয়ের পিডিএফ বানিয়ে ইন্টারনেটে ছাড়ছে। তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছে অনেকেই, সংকটে পাশে থাকার জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে তা বইয়ের ব্যবসায়ীদের কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠুকে দিচ্ছে।

একটা বই প্রকাশ পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই যদি পিডিএফ চলে আসে এবং বাজারে বিনামূল্যে পাওয়া যায়, কেউ সেটা আর দোকান থেকে কিনতে যাবে না। বাড়িতে পড়াতে পড়াতে প্রায়শই এমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে – কোনও রেফারেন্স বইয়ের নাম বললেই শুনতে হচ্ছে, ‘পিডিএফ পাওয়া যাবে না?’ আমাদের খুঁজে বার করতেও হচ্ছে, কারণ লকডাউনের বাজারে তারা আর কোথায় বই পাবে? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই যে বই থেকে সরতে থাকা- লকডাউন পরবর্তী সময়েও এটাই আমাদের অভ্যাস হয়ে যাবে। আমরা আর ছুঁয়ে দেখব না হার্ডকভার, পেপারব্যাক, নানা রঙের নানা গন্ধের বই। আমরা আর কখনও চিনব না কাগজে ছাপা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় হারিয়ে যাওয়ার সুখ। আমাদের ছেলেমেয়েরা ছোট্ট স্ক্রিনে, চোখের সর্বনাশ করে ক্ষুদে ক্ষুদে হরফ পড়বে। সাবধানী মা-বাবারা কিন্ডল কিনে দেবেন। বেড়ে উঠবে ফ্রি পিডিএফ ডাউনলোডিং সাইট। আর ক্রমশ অন্ধকারে হারিয়ে যাবে বইপাড়া। আমরা আর বই পড়ব না, বই লিখবও না, ক্রমশ আরও নতুন নতুন ডিজিটালাইজড উপায় বের করব সরাসরি লেখা ছাপানোর। আর মানুষ সভ্যতার ইতিহাসে পাওয়া এক মহার্ঘ্য আশীর্বাদ স্রেফ অনভ্যাসে ভুলে যাবে। ভুলে যাবে লেখা, ভুলে যাবে তাকে হাতেকলমে সংরক্ষণের উপায়।

তারপর একদিন কারও ফোন চুরি হবে। ল্যাপটপ খারাপ হয়ে যাবে। হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বিদ্যুৎ সংযোগ। আর দিশেহারা হয়ে সে দেখবে, তার আর কোনও উপায় নেই লেখাগুলোর কাছে ফিরে যাওয়ার। সে ছুটবে বহুদিন না যাওয়া বইয়ের দোকানে, আর দেখবে, সেখানে মিউজিয়াম তৈরি হয়ে গেছে এক দশক হল।

আমাদের বইয়ের কাছে না ফিরে উপায় নেই। যতই ডিজিটাল সংরক্ষণ হোক… সে জিনিস আদতে কিছু ডেটা মাত্র, যা tangible নয়। আমাদের কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায় রাখতেই হবে আলাদা করে… যাতে ভবিষ্যতের কোনও বৈদ্যুতিন মহামারী আমাদের জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন করে না দেয়।

বই কিনুন। বই কিনতে বলুন। পিডিএফ এত সহজলভ্য করে দেবেন না। যখন না হলেই নয়, যখন কারও উপায় নেই, সাধ্য নেই, শুধু তখনই এর সাহায্য নিন। যে সত্যিই পড়তে চাইছে তার হাতে একটা বই কিনে তুলে দিন। কিনতে যেতে পারছেন না? তাহলেও পিডিএফ নয়… সত্যিকারের বই ডেলিভারি দেয় যে অনলাইন সাইটগুলো, তাদের অর্ডার দিন, বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

যে মানুষগুলো প্রেসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, বই বাঁধে, গাড়ি টেনে দোকানে বই নিয়ে যায়, যারা দোকানে দাঁড়িয়ে নিরন্তর আউড়ে চলে বইয়ের তালিকা, যারা ছাপার যন্ত্র বানায়, যারা কাগজ বেচে, যারা প্রুফ দেখে … যে বই প্রকাশ করে… যে বই লেখে…. এদের সবার, সবার ভবিষ্যৎ আমাদের পাঠকের হাতে। আমরা যেন বিনা খরচে জ্ঞানলাভের শর্টকাট নিতে গিয়ে একটা গোটা পৃথিবীকে নষ্ট করে না দিই।

ভবিষ্যতের পৃথিবীতে লাইব্রেরিরা যেন এক-একটা স্মৃতিসৌধ হয়ে না ওঠে।

Mental Health and Lockdown

COVID 19 শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক, তা এতদিনে সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু লকডাউন উঠে গেলে দেশ পরবর্তী যে বিপদের মুখে পড়বে, তা হল দীর্ঘ গৃহবন্দী জীবনে জন্মানো একগুচ্ছ মানসিক অসুস্থতা। এমনিতেই মনের অসুখ নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা আমাদের দেশে নেই। থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট এবং সাইকায়াট্রিস্ট – তিনজনকেই ‘পাগলের ডাক্তার’ মনে করা হয়। কর্মক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের কথা জানাজানি হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ সুনজরে দেখবেন না, এমন ভয়ও পান অনেকে। ফলে করোনার মতোই, মাথার ভেতর বেড়ে চলা অন্ধকার লুকিয়ে রাখেন অনেক মানুষ।

* গৃহবন্দী থাকতে থাকতে অনেকেরই claustrophobic লক্ষণ দেখা দেয়। চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, দম আটকে আসে, শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।

* যাঁরা অন্তর্মুখী স্বভাবের, বাড়িতে অনেক মানুষের সঙ্গে আটকে পড়লে তাঁদের প্রবল অস্বস্তি হয়, যা সামাজিক সৌজন্যের কারণে প্রকাশ করা যায় না। যাঁরা ঠিক উল্টো স্বভাবের ও মিশুকে, তাঁরা বিপদে পড়েন যদি বাড়িতে সামান্য কয়েকজন সদস্য থাকেন। যথেষ্ট সামাজিক মেলামেশার সুযোগ না থাকায় তাঁরা ক্রমশ বিরক্ত হতে থাকেন। ফলে বদমেজাজ, খিটখিটে স্বভাব, অল্পেই রেগে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে। অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি।

* যাঁদের ঘর থেকে কাজ করতে হচ্ছে, বিশেষত মহিলা, তাঁরা যদি কাজের সহায়ক পরিবেশ না পান, মানসিক চাপ অসম্ভব বেড়ে যায়। কাজে বাধা পড়ার দুশ্চিন্তা, কাজকর্ম সারার আগে-পরে নিয়মিত সাংসারিক কাজ, অফিস টাইমের বাইরে কাজ এলে পরিবারের অসন্তোষের মুখে পড়া – যে কাউকে anxiety দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বাড়িতে সাহায্যকারী পরিচারক বা পরিচারিকা না আসার ফলে এই সমস্যা এক বিরাট স্ট্রেসের জন্ম দিচ্ছে নিরন্তর।

* যাঁদের বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ আগে থেকেই বিরাজমান, তাঁদের কাছে এই লকডাউন নরকের সমতুল্য। অপছন্দের মানুষের সঙ্গে বিরক্তিকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাটানো মানসিক অস্বাস্থ্যের আঁতুড়ঘর।

* ফোনের প্রতি আমাদের নির্ভরতা এই সময়ে আরও বাড়ছে। হয়তো লকডাউন ওঠার পরেও এই অভ্যেস স্থায়ী হয়ে যাবে। সময় কাটানোর জন্য অন্য মানুষের চেয়ে স্মার্টফোনভিত্তিক বিনোদনে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

* দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় কাটাতে কাটাতে অনেকেই তাঁদের কষ্টার্জিত সোশ্যাল স্কিল এবং কমিউনিকেশন স্কিল হারিয়ে ফেলবেন।

এই সমস্যাগুলির দিকে আমাদের এখন থেকেই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। Work from home করা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মহিলা ফ্যাকাল্টি, যে কিনা পূর্ণসময় একা থাকছে, তার তরফে কিছু মতামত রইল।

* বাড়িতে যতক্ষণ থাকবেন, খোলা জানালা বা বারান্দার পাশে থাকুন। আকাশ দেখুন। সামান্য শরীরচর্চা করুন ছাদে বা বারান্দায়।

* বাড়িতে থাকা প্রত্যেকটি সদস্যের comfort zone বোঝার চেষ্টা করুন। যে আত্মমগ্ন, তাকে অকারণ হইচইয়ের মধ্যে ফেলবেন না। যে বাইরে যেতে না পেরে মুষড়ে পড়ছে, তার সঙ্গে সময় কাটান। বাড়ির কমবয়সীটি ফোনে বা ভিডিও কলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে দেখলে বকাবকি করবেন না। এটা এখন তার প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। প্রয়োজনে বাড়ির সবাই বসে স্থির করে নিন, কে কীভাবে সময় কাটাতে চায়। কথা বলুন নিজের অসুবিধা নিয়ে।

* যে মানুষটিকে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে, তার ঘরের কাজের ভার নিন। তাকে একটা শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ দিন। যে কাজ আপনি বা অন্য কেউ করতে পারে, তার জন্য তাকে বারবার ডাকবেন না। এমন একটা ঘর বা ডেস্ক তাকে দিন যেখানে বাকিদের যাওয়া বারণ করে দেওয়া হবে। ঘুম থেকে উঠে তাকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দিন। অফিসের কাজের পর কিছুটা বিশ্রাম নিতে দিন। চা বানানো, রান্না, বাসন মাজা, ঘর সাফ, এগুলো ভাগ করে নিন। মনে রাখবেন, সে পরিশ্রম করছে যাতে বাকিরা ভাল থাকে। তার দক্ষতার প্রশংসা করুন। তার সমস্যা হলে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করুন।

* যদি বাড়িতে toxic environment থাকে, সচেতনভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। কোনও কথা কাটাকাটি, তর্ক, ঝগড়ায় থাকবেন না। অপছন্দের মানুষটির মুখোমুখি হবেন না। নিজেকে কাজ দিন এবং মন ঘুরিয়ে নিন। এই পরিস্থিতি একদিন কেটে যাবে যদি সামান্য বোঝাপড়া করে নেন – এই ভাবনা নিয়ে খুশিমনে কাটানোর চেষ্টা করুন।

* ফোন এখন সত্যিই জরুরি। কিন্তু অকারণ ফেসবুক স্ক্রল না করে বাড়ির লোকজনকেও কিছুটা সময় দিন। একসঙ্গে সিনেমা দেখুন। কোনও ভাল ভিডিও বা আর্টিকল পেলে পড়ে শোনান। যে ছেলেটি বা মেয়েটি অনলাইন পড়াশোনা করছে তার পাশে বসে আপনিও কয়েকটা ক্লাস করুন। ফোন ব্যবহার করতে হচ্ছেই যখন, আত্মীয়বন্ধুদের খবর নিন। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কিছু বাস্তব চরিত্রের সামনেও আসুন। তাতে মনের ভারসাম্য বজায় থাকে।

* অনেক অনেক কথা বলুন। পরিবারের সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে, ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। নিজেকে মানসিকভাবে অন্তত বিচ্ছিন্ন ভাববেন না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেজেন্টেশন অভ্যাস করুন, অনলাইন লেকচারের মহড়া দিন। ফাঁকা সময়ে কাজের বিষয়ে ভিডিও বানান। টেড টক শুনুন। গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা বা বিতর্কের আয়োজন করুন। যত বেশি কথা বলবেন, তত আপনার চর্চা বাড়বে।

আমাদের সমবেত উদ্দেশ্য, একটা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আগামী তৈরি করা। শরীরের পাশাপাশি একটা তরতাজা মন নিয়ে যেন আমরা সবাই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যেন পূর্ণ উদ্যমে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারে।

The days of corona

দেশ ভাল নেই। সময় ভাল নয়। 

 

প্রায় একমাসের কাছাকাছি হল বিশ্বামহামারীর দৌলতে আমরা ঘরবন্দি। কেউ একলা, কেউ বিদেশে, কেউ নিজভূমেই পরবাসী। যারা প্রিয়জনের কাছে… তারাও খুব একটা সুস্থ জীবন কাটাচ্ছে না। সারাক্ষণ মনে আতঙ্ক, যদি কোনওভাবে সুরক্ষাবলয় পেরিয়ে ঢুকে পড়ে একটুকরো বিষ? মানুষ বাজারে যাচ্ছেন যেন ঘরের পাশেই যুদ্ধ। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। টিভি আর খবরের কাগজে মৃত্যুর হিসেব, নতুন আক্রান্তের খবর… আর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা। পৃথিবী যেন এক লহমায় প্রলয় দেখে ফেলেছে। যে সব পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক সিনেমা বা সিরিজ অন্য সময়ে গোগ্রাসে গিলি, যেন তারই প্রতিচ্ছবি চেনা রাস্তায়, পাড়ার মোড়ে। আরও ঘন অন্ধকার ঘিরে আসছে মাথার ভেতর। ক্রমশ আরও চেপে ধরছে চার দেওয়াল, শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে। একটু আকাশ, রোদ্দুর, হাওয়ার জন্য কত আকুলিবিকুলি! শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে, সুর পথ হারাচ্ছে, বিবর্ণ হচ্ছে ছবি। এই অসময়ে কী করতে পারি আমরা?

 

আমার ব্যস্ততার অভাব নেই। অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত রুটিন ধরে অনলাইন ক্লাস চলছে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই সামান্য কথাবার্তা, পড়ানো, তাদের মুখটুকু দেখতে পাওয়া – এ যেন চারপাশের অস্বাভাবিকতা তেমন টের পেতে দিচ্ছে না। নিজস্ব পড়াশোনা বা চর্চা আছেই। তারপরেও… ক্লান্ত লাগে। সমস্ত দিন মোবাইল এর ল্যাপটপে ঘিরে থাকার পর প্রিয় সিনেমা দেখতে আর চোখ যায় না। সাংসারিক কাজকর্ম অগুনতি, অনভ্যস্ত হাতে সেসবও সামলাতে হচ্ছে বইকি! রোজকার কাজ করেন যাঁরা, তাদের ছুটি। হ্যাঁ, পারিশ্রমিক সহ। ওঁরা যদি আমাদের থেকে সাহায্য না পান, কার কাছে সাহায্য চাইবেন? আমরা হাত বাড়ালেই যাঁদের পাই, আজ তাঁদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। 

 

ব্যস্ততার ক্লান্তি বড় সুন্দর। তাকে আপাতত পাশে রেখেই সহনাগরিক হিসেবে কিছু কথা বলে যাওয়ার। হয়তো সবাই জানেন, তবু ফের বলা প্রয়োজন। 

  • পরিচ্ছন্ন থাকুন, বিচ্ছিন্ন থাকুন। যাদের বয়স কম, তারা হয়তো এই রোগের থাবা থেকে ফিরে আসবে। আসছেও। কিন্তু আমাদের এতটুকু গাফিলতি বয়স্ক, অশক্ত, দুর্বল অনেক মানুষের কাছে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। জানি, আমাদের অভ্যেস যৌথতার। কিন্তু গোষ্ঠীই যেখানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, সেখানে সংযমের কোনও বিকল্প নেই। তাছাড়া, ঐক্য একটি মানসিক ধারণা। যদি হাতে হাত না রাখলেই পাশে থাকার অনুভূতি মিথ্যে হয়ে যায়, তাহলে সে ঐক্যের ভিত্তি কী? মনে মনে ঐক্যবদ্ধ থাকুন, পাশের লোকটির থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বুঝিয়ে দিন, সঙ্গে আছি।

 

  • যে খবরের ভিত্তি নেই, তাকে বিশ্বাস করবেন না। ক’জন আক্রান্ত বা মৃত, তার পাশাপাশি ক’জন সেরে উঠল, তার পরিসংখ্যান রাখুন। যা ন্যাশনাল টেলিভিশন বা খবরের কাগজে নেই, তা দুম করে বিশ্বাস করবেন না, ছড়িয়েও দেবেন না। বাড়িতে অনেক সময় পাচ্ছেন, গুগল করতে শিখুন, নকল খবর চিনতে শিখুন। একটা ঠিক তথ্য আমাদের বহুদূর এগিয়ে দিতে পারে। অজস্র ভুল তথ্য যেন পা না চেপে ধরে।

 

  • ছাদ বা ব্যালকনিতে যান। বাড়ির সামনে দাঁড়ান। হাওয়ায় জীবাণু নেই। অন্য লোকের ড্রপলেটে আছে। মুখহাত ঢেকে দিনে একবার আকাশের নীচে দাঁড়ান।

 

  • পাড়ায় কুকুর-বেড়াল চিরকাল ছিল, পাখিরাও। তাদের গায়ে হাত দেবেন না এখন। কিন্তু যারা আপনার দরজার সামনে এসে অভ্যস্ত, তাদের অভ্যেস কেড়ে নিলে না খেয়ে মরে যাবে। কিছু বাড়তি বা বাতিল খাবার বাইরে রেখে দিন, আর একবাটি জল।

 

  • দোকান খোলা থাকছে। পাগলের মতো খাবার জমাবেন না। এক সপ্তাহের রেশন তুলে আনুন। তার বেশি নয়। আপনাকে কেউ বাঙ্কারে রেখে দিচ্ছে না। আপনার অনাবশ্যক সতর্কতায় অন্যের ক্ষতি হতে পারে। পাঁচ বস্তা মুড়ি আপনার লাগবে না। কিন্তু কেউ কেউ আছে যাদের সারাদিনের একমাত্র খাবার মুড়িই। তাদের কথা মনে রাখুন।

 

  • কুড়ি সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধোয়া যথেষ্ট। স্যানিটাইজারের সুইমিং পুল তৈরি করার প্রয়োজন নেই।

 

  • ওষুধ, মাস্ক, পিপিই কিট তাদের বেশি প্রয়োজন যারা এই অসুখে ভুগছে, কিংবা রোগীদের সরাসরি সংস্পর্শে আসছে। আপনি বাড়িতে বসে নেটফ্লিক্সই দেখবেন। অকারণে এইসব তুলে এনে বাড়িতে জমাবেন না। চৈত্র সেলের বাজার বসবে না এবারে।

 

  • চিরকাল সময়ের অভাবে করতে না পারা শখ মিটিয়ে নিন। আর, মোবাইল সরিয়ে সেই মানুষগুলোকে সময় দিন যারা একই বাড়িতে থাকে, কিন্তু আপনি ভুলে গেছেন। মনে করে দেখুন, শেষ কবে এমনিই আদিখ্যেতা করে মাকে জড়িয়ে ধরেছেন। বাবার সঙ্গে ফাজলামি মেরেছেন। বউ বা বরের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন বন্ধুর মতো। দেখবেন, বহুদিন হয়ে গেল। সময় পেয়েছেন, সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিন। কে জানে, ফের হয়তো সময় পাবেন না।

 

  • কথা বলুন। অনেক। নিজের মাতৃভাষাকে জিভে রাখুন প্রিয় স্বাদের মতো। সব মনখারাপ উগরে দিন। যে আড্ডা বাইরে হচ্ছে না, ভিডিও কলে সারুন নিয়ম করে। গালাগাল দিন, ইয়ার্কি মারুন, জোক বলুন, লকডাউন উঠলে কী কী করবেন তার প্ল্যান করুন জমিয়ে। অনেক কথা ভাসিয়ে দিক থমথমে আতঙ্ক।

 

  • বই পড়ুন। শুধু কিন্ডল বা মোবাইলে নয়, আঙুল দিয়ে পৃষ্ঠা ছুঁয়ে। আমাদের অনেক গল্প লেখা হয়ে গেছে। অনেক অসময়ের দলিল বইয়ের হরফগুলো। অনেক চরিত্রের যাপন, অনেক মনস্তত্ত্বের আনাগোনা তারা জমিয়ে রেখেছে। তাদের চিনে নিন। কে বলতে পারে, হয়তো আপনিই খুঁজে পেয়ে গেলেন ভাল থাকার চাবি!

 

  • আরও কত কী করার আছে! যা ভাল লাগে করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। সবই তো কেটে যায়। বিচ্ছেদ, বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ। ইতিহাস সাক্ষী, সময়ের কাছে কেউ জয়ী নয়। আজ সময় নিজে থেকে ধরা দিয়েছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে এই মহামারীকাল আমরা পেরিয়ে যাব ঠিকই। হয়তো বলার মতো গল্প থেকে যাবে, ‘জানিস তো, আমরা প্যানডেমিক দেখেছিলাম!’ উত্তরে আপনার নিষ্পাপ আগামী জানতে চাইবে, ‘তখন তুমি কী করছিলে?’ আমরা তখন যেন বলতে পারি, ‘মানুষের পক্ষে ছিলাম। সৃষ্টির পক্ষে ছিলাম। শুভপক্ষে ছিলাম।’

সবাই সুস্থ থাকবেন। 

 

Skip to content