COVID 19 শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক, তা এতদিনে সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু লকডাউন উঠে গেলে দেশ পরবর্তী যে বিপদের মুখে পড়বে, তা হল দীর্ঘ গৃহবন্দী জীবনে জন্মানো একগুচ্ছ মানসিক অসুস্থতা। এমনিতেই মনের অসুখ নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতা আমাদের দেশে নেই। থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট এবং সাইকায়াট্রিস্ট – তিনজনকেই ‘পাগলের ডাক্তার’ মনে করা হয়। কর্মক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের কথা জানাজানি হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ সুনজরে দেখবেন না, এমন ভয়ও পান অনেকে। ফলে করোনার মতোই, মাথার ভেতর বেড়ে চলা অন্ধকার লুকিয়ে রাখেন অনেক মানুষ।
* গৃহবন্দী থাকতে থাকতে অনেকেরই claustrophobic লক্ষণ দেখা দেয়। চার দেয়ালের বাইরে যাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, দম আটকে আসে, শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।
* যাঁরা অন্তর্মুখী স্বভাবের, বাড়িতে অনেক মানুষের সঙ্গে আটকে পড়লে তাঁদের প্রবল অস্বস্তি হয়, যা সামাজিক সৌজন্যের কারণে প্রকাশ করা যায় না। যাঁরা ঠিক উল্টো স্বভাবের ও মিশুকে, তাঁরা বিপদে পড়েন যদি বাড়িতে সামান্য কয়েকজন সদস্য থাকেন। যথেষ্ট সামাজিক মেলামেশার সুযোগ না থাকায় তাঁরা ক্রমশ বিরক্ত হতে থাকেন। ফলে বদমেজাজ, খিটখিটে স্বভাব, অল্পেই রেগে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে। অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি।
* যাঁদের ঘর থেকে কাজ করতে হচ্ছে, বিশেষত মহিলা, তাঁরা যদি কাজের সহায়ক পরিবেশ না পান, মানসিক চাপ অসম্ভব বেড়ে যায়। কাজে বাধা পড়ার দুশ্চিন্তা, কাজকর্ম সারার আগে-পরে নিয়মিত সাংসারিক কাজ, অফিস টাইমের বাইরে কাজ এলে পরিবারের অসন্তোষের মুখে পড়া – যে কাউকে anxiety দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বাড়িতে সাহায্যকারী পরিচারক বা পরিচারিকা না আসার ফলে এই সমস্যা এক বিরাট স্ট্রেসের জন্ম দিচ্ছে নিরন্তর।
* যাঁদের বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ আগে থেকেই বিরাজমান, তাঁদের কাছে এই লকডাউন নরকের সমতুল্য। অপছন্দের মানুষের সঙ্গে বিরক্তিকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাটানো মানসিক অস্বাস্থ্যের আঁতুড়ঘর।
* ফোনের প্রতি আমাদের নির্ভরতা এই সময়ে আরও বাড়ছে। হয়তো লকডাউন ওঠার পরেও এই অভ্যেস স্থায়ী হয়ে যাবে। সময় কাটানোর জন্য অন্য মানুষের চেয়ে স্মার্টফোনভিত্তিক বিনোদনে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
* দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় কাটাতে কাটাতে অনেকেই তাঁদের কষ্টার্জিত সোশ্যাল স্কিল এবং কমিউনিকেশন স্কিল হারিয়ে ফেলবেন।
এই সমস্যাগুলির দিকে আমাদের এখন থেকেই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। Work from home করা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মহিলা ফ্যাকাল্টি, যে কিনা পূর্ণসময় একা থাকছে, তার তরফে কিছু মতামত রইল।
* বাড়িতে যতক্ষণ থাকবেন, খোলা জানালা বা বারান্দার পাশে থাকুন। আকাশ দেখুন। সামান্য শরীরচর্চা করুন ছাদে বা বারান্দায়।
* বাড়িতে থাকা প্রত্যেকটি সদস্যের comfort zone বোঝার চেষ্টা করুন। যে আত্মমগ্ন, তাকে অকারণ হইচইয়ের মধ্যে ফেলবেন না। যে বাইরে যেতে না পেরে মুষড়ে পড়ছে, তার সঙ্গে সময় কাটান। বাড়ির কমবয়সীটি ফোনে বা ভিডিও কলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে দেখলে বকাবকি করবেন না। এটা এখন তার প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। প্রয়োজনে বাড়ির সবাই বসে স্থির করে নিন, কে কীভাবে সময় কাটাতে চায়। কথা বলুন নিজের অসুবিধা নিয়ে।
* যে মানুষটিকে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে, তার ঘরের কাজের ভার নিন। তাকে একটা শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ দিন। যে কাজ আপনি বা অন্য কেউ করতে পারে, তার জন্য তাকে বারবার ডাকবেন না। এমন একটা ঘর বা ডেস্ক তাকে দিন যেখানে বাকিদের যাওয়া বারণ করে দেওয়া হবে। ঘুম থেকে উঠে তাকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দিন। অফিসের কাজের পর কিছুটা বিশ্রাম নিতে দিন। চা বানানো, রান্না, বাসন মাজা, ঘর সাফ, এগুলো ভাগ করে নিন। মনে রাখবেন, সে পরিশ্রম করছে যাতে বাকিরা ভাল থাকে। তার দক্ষতার প্রশংসা করুন। তার সমস্যা হলে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করুন।
* যদি বাড়িতে toxic environment থাকে, সচেতনভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। কোনও কথা কাটাকাটি, তর্ক, ঝগড়ায় থাকবেন না। অপছন্দের মানুষটির মুখোমুখি হবেন না। নিজেকে কাজ দিন এবং মন ঘুরিয়ে নিন। এই পরিস্থিতি একদিন কেটে যাবে যদি সামান্য বোঝাপড়া করে নেন – এই ভাবনা নিয়ে খুশিমনে কাটানোর চেষ্টা করুন।
* ফোন এখন সত্যিই জরুরি। কিন্তু অকারণ ফেসবুক স্ক্রল না করে বাড়ির লোকজনকেও কিছুটা সময় দিন। একসঙ্গে সিনেমা দেখুন। কোনও ভাল ভিডিও বা আর্টিকল পেলে পড়ে শোনান। যে ছেলেটি বা মেয়েটি অনলাইন পড়াশোনা করছে তার পাশে বসে আপনিও কয়েকটা ক্লাস করুন। ফোন ব্যবহার করতে হচ্ছেই যখন, আত্মীয়বন্ধুদের খবর নিন। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কিছু বাস্তব চরিত্রের সামনেও আসুন। তাতে মনের ভারসাম্য বজায় থাকে।
* অনেক অনেক কথা বলুন। পরিবারের সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে, ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। নিজেকে মানসিকভাবে অন্তত বিচ্ছিন্ন ভাববেন না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেজেন্টেশন অভ্যাস করুন, অনলাইন লেকচারের মহড়া দিন। ফাঁকা সময়ে কাজের বিষয়ে ভিডিও বানান। টেড টক শুনুন। গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা বা বিতর্কের আয়োজন করুন। যত বেশি কথা বলবেন, তত আপনার চর্চা বাড়বে।
আমাদের সমবেত উদ্দেশ্য, একটা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আগামী তৈরি করা। শরীরের পাশাপাশি একটা তরতাজা মন নিয়ে যেন আমরা সবাই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যেন পূর্ণ উদ্যমে জীবনের মূল স্রোতে ফিরতে পারে।