বিজ্ঞান চর্চায় উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উপযোগিতা

মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ত্ব নিয়ে বহুকাল ধরে আলোচনা হয়ে চলেছে। অনেকের মতে মাতৃভাষায় পাঠ দেশের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের অনেকাংশে ক্ষতি করছে, তাদের নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। তবে এই মতকে পরিপুর্ণরূপে  স্বীকার করে নেওয়া যায় না। অনেক দার্শনিক এই মতের বিপক্ষে তাদের যুক্তি প্রস্তুত করে প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচিত ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।  বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রসঙ্গে  তিনি তার সুচিন্তিত যুক্তি প্রস্তুত করেছেন।

  • কেন অপচয় : এক ব্যবহারিক সম্যস্যার সূত্র দিয়ে এই প্রবন্ধের সূচনা। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন ভারতীয় ছাত্রদের হাতে কলমে অভিজ্ঞতার অভাব ও ব্যর্থতা। প্রতি বছরই এই দেশ থেকে বেশ কিছু শাত্র বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে যায়। এরা বিদেশে যায় মূলত মেক্যানিকাল ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার নানা শাখায় শিক্ষা লাভের জন্য। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায় ভারতীয় ছাত্রদের সেই প্রাথমিক শিক্ষার অভাব রয়েছে যা থাকলে তাদের পক্ষে বিদেশের আধুনিক কর্মপদ্ধতি দ্রুত আয়ত্ত করা সম্ভব হত। প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিক আমেরিকা প্রত্যাগত এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। উক্ত শিক্ষাবিদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ইঞ্জিন চালাতে বললে ভারতবর্ষের ছেলেরা ভয় পায় ও অস্বস্তি অনুভব করে। এর কারণ তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাব। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু মুখস্থই করতে শেখায়। ব্যবহারিক কোনও জ্ঞান অর্জন করায় না। অথচ প্রতিবছর আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য ছেলে পাশ করে বেরোয়। কিন্তু হাতেকলমে শিক্ষার অভাবে সেই শিক্ষা কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে না। ফলে শিক্ষার প্রসারে আমাদের জাতীয় প্রয়াস আসলে অপচয়ের নামান্তর। তাই তিনি বলেছেন, ‘কি বিপুল অপচয় আমাদের এই জাতীয় প্রয়াসের’।
  • অপচয় এড়ানোর উপায় : এই অপচয় এড়ানোর উপায় প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক তাঁর সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন। তাঁর মতে ভারতীয় ছাত্রদের এই হীনমন্যতা দূর করার একটি মূল উপায় হল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। ভারতীয় ছাত্রদের এই আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই সত্যেন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধের মূল বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন। এই প্রাথমিক প্রস্তুতি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তাঁর মতে অবশ্যই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ না করতে পারার কারণেই গড়ে উঠেছে। তাই তাঁর প্রস্তাব ‘ আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে’। নিজের দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেছেন, ছাত্রদের সঙ্গে মাতৃভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনাই বিজ্ঞানের প্রাথমিক বা উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য জরুরি। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের সপক্ষে কিছু যুক্তি সাজিয়েছেন তিনি। প্রথমত, ছাত্রদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ়তর ভিত্তি স্থাপনের জন্য ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সমস্যার খোলাখুলি আলোচনা জরুরি ও তাদের এক সঙ্গ কাজ করা উচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও বিদেশী ভাষা এসে দাঁড়ালে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র অনেকসময়ই ঠিক মতো মনের কথা বলতে পারে না। এবং শিক্ষকও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে , ছাত্রকে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, সে তার সবটাই বুঝতে পেরেছে কিনা। সেক্ষেত্রে শিক্ষনীয় বিষয়ের অনুশীলন অপেক্ষা বিদেশী ভাষার অনুশীলনে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। তাতে সময় বাঁচানো তো দূরের কথা, সময়ের আরও অপচয় হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য অপেক্ষা উপলক্ষ্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় শিক্ষণীয় বিষয়টি ছাত্রদের কাছে ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। ফলে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠবে না। তৃতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সহযোগিতার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিদেশী ভাষা। ফলে সম্মিলিত প্রয়াসে সমস্যা সমাধানে অসুবিধা সৃষ্টি হবে। তাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মূলত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানকেই অপচয় এড়ানোর উপায় বলে মনে করেছেন।

 

  • নালন্দা-তক্ষশীলার শিক্ষাদর্শনের সমালোচনা : কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ভাগ্যবিধাতারা এখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শেই বিশ্বাসী। সমসাময়িকতার বাস্তব চাহিদাকে তাঁরা স্বীকার করতে চান না। তাঁদের এই মানসিকতার পিছনে রয়েছে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের চোখে ক্ল্যাসিক চর্চা, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল, হিউম্যানিটিজ, ভাষা ও আইন শিক্ষাই আদর্শ। বিজ্ঞানের উপযোগিতা তাঁরা স্বীকার করলেও বিজ্ঞানীকে দেখেন সন্দেহের চোখে। তারা মনে করেন ভারতবর্ষের পুরানো আদর্শের স্থান নিতে পারে বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছুই নেই। রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্যমুখীন জীবন গড়ে তোলা সম্ভব প্রাচীন দর্শনের ভিত্তিতেই। বিজ্ঞানের সেখানে বিশেষ প্রয়োজন নেই। ভারতবর্ষের পণ্ডিতমহলের এই মানসিকতার ঘোরতর সমালোচনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রাচীনকাল থেকে ভারতবাসীর মনে যে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস রয়েছে তার ফলশ্রুতিই এই বিজ্ঞানবিরোধী মানসিকতা। তিনি বলেছেন নালন্দা বা তক্ষশীলার মতো ভারতবর্ষের প্রাচীন উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে পারলৌকিকতার চর্চা করা হত। ভারতীয় দার্শনিকতার মূল কথাই হল এই সমস্যা জর্জর পৃথিবীকে দুদিনের পান্থশালা ভেবে নিয়ে পার্থিব বিষয় সম্পর্কে উদাসীন থাকা। এই ঔদাসীন্যের কারণেই প্রাবন্ধিকের মতে ভারতীয়রা জাগতিক ব্যাপারে আধিপত্য হারিয়ে বারবার বিদেশী শক্তির হাতে পরাজিত হয়েছে, দাসত্ব শৃঙ্খল বরণ করেছে। তাই সত্যেন্দ্রনাথের পরামর্শ : ‘আধুনিক কালের ভারতীয়কে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের উপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার পাঠ গ্রহণ করা উচিত’। দেশের উন্নতির জন্য সমস্যাকে জয় করা দরকার। সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে দার্শনিক ঔদাসীন্যে মোক্ষলাভের কথা বললে দেশ ক্রমশ আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে।

মাতৃভাষায় শিক্ষা ও শিক্ষালাভের উপকারিতা

একটি শিশু জন্মর পর প্রথম যে ভাষা শোনে এবং কথা বলা শুরু করে তা হল তার মাতৃ ভাষা। এই ভাষার প্রতি  বিশ্বাস ও আস্থা অপরিসীম। নিজের পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রভাবে জড়িয়ে থাকে এই ভাষা।  তাই প্রাথমিক স্তরে যখন অন্যান্য বিষয় প্রচলন করা হয় তখন যদি বিদেশি ভাষার কাঠিন্যকে পরিহার করে মাতৃভাষায় তা পড়ান হয় তাহলে হয়ত শিক্ষালাভের পদ্ধতি কিছুটা সহজ ও  আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। এ বিষয়ে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর লেখা “ শিক্ষা ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধটির কথা আলোচনা করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বৈজ্ঞানিক হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু দেশের শিকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ তিনি কোনওদিন হারিয়ে ফেলেননি। বিজ্ঞানী হয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর আত্যন্তিক আগ্রহ। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে প্রয়াস আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নিয়েছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ এই আদর্শে বিশ্বাসী সত্যেন্দ্রনাথ আমাদের আলোচ্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান নামক প্রবন্ধেও সেই একই বিষয় উদাহরণ-সহ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।  

  • এক ব্যবহারিক সম্যস্যার সূত্র দিয়ে এই প্রবন্ধের সূচনা। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন ভারতীয় ছাত্রদের হাতে কলমে অভিজ্ঞতার অভাব ও ব্যর্থতা। প্রতি বছরই এই দেশ থেকে বেশ কিছু ছাত্র বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় , কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে যায়। এরা বিদেশে যায় মূলত মেক্যানিকাল ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার নানা শাখায় শিক্ষা লাভের  জন্য। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায় ভারতীয় ছাত্রদের সেই প্রাথমিক শিক্ষার অভাব রয়েছে যা থাকলে তাদের পক্ষে বিদেশের আধুনিক কর্মপদ্ধতি দ্রুত আয়ত্ত করা সম্ভব হত। প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিক আমেরিকা প্রত্যাগত এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। উক্ত শিক্ষাবিদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ইঞ্জিন চালাতে বললে ভারতবর্ষের ছেলেরা ভয় পায় ও অস্বস্তি অনুভব করে। এর কারণ তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাব। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু মুখস্থই করতে শেখায়। ব্যবহারিক কোনও জ্ঞান অর্জন করায় না। অথচ প্রতিবছর আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য ছেলে পাশ করে বেরোয়। কিন্তু হাতেকলমে শিক্ষার অভাবে সেই শিক্ষা কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে না। ফলে শিক্ষার প্রসারে আমাদের জাতীয় প্রয়াস আসলে অপচয়ের নামান্তর। তাই তিনি বলেছেন,  ‘কি বিপুল অপচয় আমাদের এই জাতীয় প্রয়াসের’।
  • এই প্রাথমিক প্রস্তুতি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তাঁর মতে অবশ্যই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ না করতে পারার কারণেই গড়ে উঠেছে। তাই তাঁর প্রস্তাব ‘ আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে’। নিজের দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেছেন, ছাত্রদের সঙ্গে মাতৃভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনাই বিজ্ঞানের প্রাথমিক বা উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য জরুরি। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের সপক্ষে কিছু যুক্তি সাজিয়েছেন তিনি।
  • প্রথমত, ছাত্রদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ়তর ভিত্তি স্থাপনের জন্য ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সমস্যার খোলাখুলি আলোচনা জরুরি ও তাদের এক সঙ্গ কাজ করা উচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও বিদেশী ভাষা এসে দাঁড়ালে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র অনেকসময়ই ঠিক মতো মনের কথা বলতে পারে না। এবং শিক্ষকও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে , ছাত্রকে যা বোঝাতে চ্যেছিলেন, সে তার সবটাই বুঝতে পেরেছে কিনা। সেক্ষেত্রে শিক্ষনীয় বিষয়ের অনুশীলন অপেক্ষা বিদেশী ভাষার অনুশীলনে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। তাতে সময় বাঁচানো তো দূরের কথা, সময়ের আরও অপচয় হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য অপেক্ষা উপলক্ষ্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় শিক্ষণীয় বিষয়টি ছাত্রদের কাছে ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। ফলে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠবে না। তৃতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সহযোগিতার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিদেশী ভাষা। ফলে সম্মিলিত প্রয়াসে সমস্যা সমাধানে অসুবিধা সৃষ্টি হবে।

বিপক্ষে যুক্তি : মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সপক্ষে এই সব যুক্তি অবশ্যই সেদিনকার শিক্ষামহলে সাদরে গৃহীত হয় নি। সত্যেন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবের বিপক্ষে নানা বিরুদ্ধ যুক্তি উঠে আসতে থাকে। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জানান যে, ভারতবর্ষের বহু প্রদেশ, সেখানে বহুবিধ ভাষা প্রচলিত। তাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আন্তর্জাতিক ইংরাজি ভাষার পরিবর্তে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহৃত হয় তাহলে বিদ্যায়তনিক চলাচল বা আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারের ফলে ভারতীয় সমাজে উগ্র প্রাদেশিক বোধও গড়ে উঠতে পারে, যা শিক্ষা ও সমাজ উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। এই দুই যুক্তি ছাড়াও অনেকে এটাও বলেছেন যে, বিদেশী ইংরাজি ভাষা নাকি আমাদের সংহতির সপক্ষে কাজ করছে এবং আমাদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পুনরাবিষ্কার এই ইংরাজি ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই প্রাদেশিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ বিশেষ কোনও প্রয়োজনীয় বিষয় নয়।    

বিপক্ষ যুক্তি খণ্ডন : কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই সব যুক্তিকে মানতে চাননি। তাঁর মতে ‘এই সব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শেই বিশ্বাসী’। সমসাময়িকতার বাস্তব চাহিদাকে তাঁরা স্বীকার করতে চান না। তাঁদের এই মানসিকতার পিছনে রয়েছে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের চোখে ক্ল্যাসিক চর্চা, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল, হিউম্যানিটিজ, ভাষা ও আইন শিক্ষাই আদর্শ। বিজ্ঞানের উপযোগিতা তাঁরা স্বীকার করলেও বিজ্ঞানীকে দেখেন সন্দেহের চোখে। তারা মনে করেন ভারতবর্ষের পুরানো আদর্শের স্থান নিতে পারে বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছুই নেই। রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্যমুখীন জীবন গড়ে তোলা সম্ভব প্রাচীন দর্শনের ভিত্তিতেই। বিজ্ঞানের সেখানে বিশেষ প্রয়োজন নেই।

  • ভারতবর্ষের পণ্ডিতমহলের এই মানসিকতার ঘোরতর সমালোচনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রাচীনকাল থেকে ভারতবাসীর মনে যে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস রয়েছে তার ফলশ্রুতিই এই বিজ্ঞানবিরোধী মানসিকতা। তিনি বলেছেন নালন্দা বা তক্ষশীলার মতো ভারতবর্ষের প্রাচীন উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে পারলৌকিকতার চর্চা করা হত। ভারতীয় দার্শনিকতার মূল কথাই হল এই সমস্যাজর্জর পৃথিবীকে দুদিনের পান্থশালা ভেবে নিয়ে পার্থিব বিষয় সম্পর্কে উদাসীন থাকা। এই ঔদাসীন্যের কারণেই প্রাবন্ধিকের মতে ভারতীয়রা জাগভারতীয়কে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের উপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার পাঠ গ্রহণ করা উচিত’। দেশের উন্নতির জন্য সমস্যাকে জয় করা দরকার। সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে দার্শনিক ঔদাসীন্যে মোক্ষলাভের কথা বললে দেশ ক্রমশ আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে। তিক ব্যাপারে আধিপত্য হারিয়ে বারবার বিদেশী শক্তির হাতে পরাজিত হয়েছে, দাসত্ব শৃঙ্খল বরণ করেছে।

সত্যেন্দ্রনাথের মতে বিজ্ঞানই পারবে ভারতবর্ষকে আধুনিক পৃথিবীর প্রথম সারিতে স্থান করে দিতে। আর তাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা করা দরকার। সেই আত্মবিশ্বাস একমাত্র মাতৃভাষার পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। অনেকের মতে ভারতীয় ভাষাগুলিতে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব বাধাসৃষ্টি করতে পারে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। সত্যেন্দ্রনাথের মতে পরিভাষার অভাবের ক্ষেত্রে ইংরাজি টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। ছাত্ররা যদি এই শব্দ সহজেই বোঝে তবে ধার করা শব্দ হিসাবেই তা টিকে থাকবে ও  সমৃদ্ধ করবে আমাদের জাতীয় শব্দভাণ্ডার। বহু বিদেশী শব্দ এভাবেই ভারতবর্ষের প্রাদেশিক ভাষাগুলিতে এর আগেও যুক্ত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে বিরোধিতার মানে নেই। তাছাড়া অনেকসময় বৈজ্ঞানিক শব্দের তর্জমা পণ্ডশ্রম মাত্র। রেলওয়ে, কিলোগ্রাম, সেন্টিমিটার, ব্যাকটেরিয়া –এই সব ভিন্ন ভাষার শব্দ সবাই বোঝেন ও ব্যবহার করেন। তাই এইসব প্রচলিত শব্দের পরিভাষা না খুঁজলেও চলে।  

কোভিড পরবর্তী সময়ে স্কুল-কলেজ জীবন কেমন হতে চলেছে

বিশ্ব জুড়ে চলেছে এক অতিমারী- কোভিড ! যার প্রভাব সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের জন্য কোভিড মহামারী এক অত্যন্ত কঠিন সময় তবে এই কঠিন দিনগুলি কাটিয়ে আমাদের প্রত্যেককেই স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরতে হবে। আজ আমরা এই সময়ের কিছু স্বাভাবিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব। 

কবে এবং কিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুলবে? 

  • পৃথিবী জুড়ে যে কোভিড মহামারী ছড়িয়েছে সেই দিনগুলিকে অতিক্রম করে ক্রমশ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলি খুলছে। বিশ্ব জুড়ে স্কুল বন্ধের নির্দেশ কাটিয়ে প্রায় সত্তরটি দেশ স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কবে ,কখন , কোন পরিস্থিতে এই সিদ্ধান্ত লাগু হবে তা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যৌথ আলোচনার মাধ্যমে স্থিরীকৃত হবে।  এ  ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রশাসনের ও বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে।
  • সাধারণের স্বাস্থ্য, শিক্ষাদানের সুবিধা ও সঙ্কট , রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিচার করেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

অভিভাবকদের মনে প্রথমেই যে প্রশ্ন জাগবে তা হল- আমার সন্তানের স্কুলে যাওয়া কতটা নিরাপদ? 

  • এ বিষয়ে প্রথমেই বলা যায় শিক্ষার্থীদের জন্য যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে, কেবলমাত্র তখনি প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার অনুমতি পাবে । এর জন্য যথাযথ ভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী  জীবাণুমুক্ত   করণ করতে হবে। বিধিসম্মতভাবে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।ছাত্র-ছাত্রীদের ছোট ছোট দলে ভেঙ্গে সেকশন ভাগ করে ক্লাস করানোর ব্যাবস্থা করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকা বাধ্যতামূলক। মুখে মাস্ক পরা আবশ্যিক।

কোভিডের ভাইরাস যাতে না ছড়ায় তার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি কি কি ব্যবস্থা নিতে পারে? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নিশ্চই খুলবে তবে শিক্ষার্থী , শিক্ষক , অশিক্ষক কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে যা যা পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারেঃ

  • ক্লাস শুরু ও শেষের সময়সূচীর পরিবর্তন
  • নির্দিষ্ট সময় অন্তর হ্যান্ড স্যানিটাইজে্সনের ব্যবস্থা করা
  • অধিক সংখ্যক ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করা
  • টিফিনের সময় যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা
  • বিভিন্ন শিফটে স্কুলে ক্লাস করা যাতে ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়
  • পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা
  • পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করা
  • সর্বসময়ের জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে যাতে নাক ও মুখ আবৃত থাকে
  • শুধুমাত্র ছাত্র ছাত্রী নয় , স্কুলের সমস্ত শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে।

   চিকিৎসকদের নির্দেশ এই অভ্যাসগুলিকে  আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী করে ফেলা দরকার। আগামী কয়েক বছর  এই ভাইরাস আমদের প্রতিনিয়ত আক্রমণ করবে তাই ব্যক্তিগত অভ্যাস ও জীবন চর্জায় যদি আমরা এই আচার গুলিকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারি তবেই হয়ত আমাদের পরিবার তথা বৃহত্তর সমাজ সুরক্ষিত থাকতে পারবে।

দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ না যাওয়ার ফলে যদি আমার সন্তান পিছিয়ে পরে— 

পড়াশোনার পাশাপাশি সন্তানের মানসিক স্বাস্থের প্রতিও আমাদের যত্নবান হতে হবে।দীর্ঘ কয়েক মাসের বেশি সময় ধরে সে বাড়ি থেকে বেরোয় নি, স্কুলে যায় নি, সামাজিক ব্যবহারে তার ছেদ পরেছে।খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলে ফেরার প্রাথমিক দিনগুলি হয়ত সহজ হবে না। আপনাকেও যেমন কাজে যোগ দেবার আগে নিজের মানসিক প্রস্তুতি নিতে তবে  ঠিক তেমনি আপনার সন্তানের দিকেও সাহাজ্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মনে করুন আপনার সন্তানের স্কুলে যাবার প্রথম দিন গুলির কথা। বেশিভাগ দিনই যে আপনার সাহচর্জ ছেড়ে অচেনা গন্ডিতে নিয়মের অনুশাসনের মধ্যে স্কুলে  যেতে চাইত না। তখন যেমন তাকে বুঝিয়ে স্কুলে পাঠাতেন আজও আবার নতুন করে আপনার সন্তানের মনের খবর  নিন। তাকে বোঝান যে স্কুলে তার সব বন্ধুরা আবার আসবে।হয়ত আগের মত এখন একসঙ্গে সকলে মিলে পায়ে পা মিলিয়ে ফুটবল খেলতে পারবে না কিন্তু এই এতদিনের নিভৃতবাসের আলাপচারিতা তো করা যাবে।

দেখবেন একটু সময় দিলেই আপনার দশ বছরের সন্তান নিজে থেকেই আবার স্কুল জীবনে ফিরে যেতে চাইবে।কোন নিয়মের ভার এখনি চাপিয়ে দেবেন না তার উপর। সময়ের সাথে একটু একটু করে দেখবেন সে এই নতুন পরিস্থিতিকে ও মেনে নিচ্ছে।কলেজে পড়া প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের মনে করিয়ে দিন বিকেলে ক্লাসের পর কমন রুমে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবার দিন গুলির কথা। এমনিতেই হয়ত বাইড়ে বেড়তে না পেরে তারা অনেকেই হাঁফিয়ের উঠেছে । খবর নিন তাদের মনের ও।

দীর্ঘ কঠিন সময় কাটিয়ে আমাদের প্রত্যেক্কেই কাজে ফিরতে হবে। কোভিড পুর্ব আর কোভিড পরবর্তী সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে আমূল পরিবর্তন।সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে অন-লাইন পড়াশোনার চর্চা ।তা নিয়েও ছেলে মেয়েদের মনে চলছে নানা উৎকণ্ঠা । অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি সেদিকেই পরিবর্তিত হবে, তবে এখনও ক্লাসে  সামনাসামনি শিক্ষা দানের পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাচ্ছে না।তবে মানুষেরই আছে এই পরিবর্তনের সঙ্গে রঙ  মিলিয়ে এগিয়ে চলার ক্ষমতা। তাই যথাযথ সচেতনতা আর অভ্যাস আমাদের এই নতুন পথ চলাকে করে তুলবে মসৃণ ও প্রবহমান। কারণ থেমে যাওয়াকে জীবন বলে না। বদলে যাওয়া পৃথিবীর প্রতিটি পরিবর্তনকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করাই হল বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র।

The Significance of Thespian Bijon Bhattacharya and IPTA in the international context

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ভারতীয় গণনাট্য সংঘ

নিছক প্রমোদসর্বস্বতা থেকে জীবন সচেতনতার দিকে, রোমান্সের আড়ম্বর ও ভাবালুতা থেকে বাস্তব জীবনচেতনা সমৃদ্ধ শিল্পীত নাটকের দিকে প্রথম দিক নির্দেশ করে চল্লিশের দশকের ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলন। সেই গণনাট্য সংঘেরই পতাকাতলে দাঁড়িয়ে একসময়ে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও রঙ্গমঞ্চে আত্মনিয়োগ করেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। যে সময়ে বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বিজন ভট্টাচার্য নাটক লিখতে শুরু করলেন, সেই সময় শুধু ভারতে নয়, সমগ্র আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই এক চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩১-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একদিকে বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী প্রভাব ও অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রবিপ্লবে বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত করাতে এবং এর থেকে উত্তরণের পন্থা জানানোর জন্য গণনাট্য সংঘ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলি আবর্তিত হয়েছিল জীবনের বাস্তব সমস্যাকে কেন্দ্র করে।

  • ১৯৪৩ সালের মে মাসে গঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। বিজন ভট্টাচার্য সূচনার দিন থেকেই এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। সেই সময়, কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের সদস্যপদ গ্রহণের কিছু আগে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম নাটক আগুন (১৯৪৩)। এই নাটক সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হওয়ার পরে রচনা করেন জবানবন্দী (১৯৪৩) এবং বিখ্যাত নবান্ন (১৯৪৪) নাটক। এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লিখলেন গীতিনাট্য জীয়নকন্যা (১৯৪৭), শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অবরোধ (১৯৪৭), সংগ্রামী শিল্পীর শপথের কাহিনি নিয়ে মরাচাঁদ (১৯৪৬)। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত মতবিরোধ বাড়তে থাকায় তিনি ১৯৫০ সালে গঠন করেন নিজস্ব নাট্য সংস্থা ক্যালকাটা থিয়েটার। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তিনি সুনিপুণ ভাবে রচনা ও প্রযোজনা করেন গোত্রান্তর (১৯৫৭), ছায়াপথ (১৯৬১), দেবীগর্জন (১৯৬৬), গর্ভবতী জননী (১৯৬৭) ইত্যাদি নাটক। ১৯৭০ সালে ক্যালকাটা থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি গঠন করলেন নতুন নাট্যদল কবচকুণ্ডল। প্রযোজনা করলেন আজ বসন্ত (১৯৭০), চলো সাগরে (১৯৭৭) ইত্যাদি নাটক। জীবন-প্রত্যয়ী নাটক রচনা ও উপস্থাপনার সংকল্পে আমৃত্যু অনমনীয় বিজন ভট্টাচার্য ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
  • চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষ , মহামারী, বন্যা বিপর্যস্ত বাংলাদেশে গণনাট্য সংঘের কর্মধারার বিস্তার ঘটে। এই প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক আগুন। এই নাটকটি পাঁচটি বিভিন্ন দৃশ্যের সমবায়ে গড়া স্কেচধর্মী রচনা। খাদ্যাভাব, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমাগত বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতা এবং আসন্ন বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে এই নাটকে রূপ দিয়েছেন নাট্যকার। নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৯৪৩ সালের মে মাসে তৎকালীন নাট্যভারতী মঞ্চে।
  • এর মধ্যে সামাজিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে গণনাট্য সংঘের কাছে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি পরিস্থিতির আরও তৎপর নাট্য-রূপায়ণ চাইলেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে রচিত হল তাঁর দ্বিতীয় একাঙ্ক নাটক জবাননন্দী। এই নাটকটিকে বিখ্যাত নবান্ন নাটকের প্রাক-খসড়া বলা যেতে পারে। এই নাটকে গ্রাম থেকে উৎপাটিত কৃষক জীবনের যে যন্ত্রণা রূপায়িত হয়েছে, নবান্ন নাটকে তারই বিস্তৃত প্রকাশ দেখা যায়। জবানবন্দী চারটি দৃশ্যে বিভক্ত। মহামারীতে বিপর্যস্ত, ক্ষুধার তাড়নায় গৃহহীন মানুষেরা শহরে এসে সেখানকার মানুষের নিস্পৃহতা, লোভ ও লালসার শিকার হয়। এই নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায়।
  • বিজন ভট্টাচার্যের পরবর্তী যে পূর্ণাঙ্গ নাটকটি বাংলা নাটক ও নাট্য-অভিনয়ের ইতিহাসে এক পর্বান্তরের সৃষ্টি করেছিল, তা হল নবান্ন। তৎকালীন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এই নাটকটি রচনা করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভের সময় বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলে, তিনি যদি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ না করতেন এবং ৪৪-এর মন্বন্তর না দেখতেন, তা হলে তিনি নবান্ন নাটক লিখতে পারতেন না। নবান্ন চার অঙ্কে বিন্যস্ত। প্রতিটি অঙ্ক আবার কয়েকটি করে দৃশ্যে বিভক্ত। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটি বর্ণিত হয়েছে আমিনপুর গ্রামের পটভূমিকায়, ৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের পুলিশি সন্ত্রাস, মহামারী, সাইক্লোন ইত্যাদির ছবি দিয়ে। দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় গ্রামীণ কৃষক প্রধান সমাদ্দার ও তার পরিবার অভাবের তাড়নায় শহরে এসে হাজির হয়েছে। এই ভাবে বিভিন্ন অঙ্কের বিভিন্ন দৃশ্যে তৎকালীন সাধারণ মানুষের নিদারুণ দুর্গতির ছবি বিজন ভট্টাচার্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু বিপর্যয়ই শেষ কথা নয়। মন্বন্তরের শেষে গ্রামে ফিরে এসে নতুন ধানের উৎসব নবান্নের মাধ্যমে নাটকটির সমাপ্তি। চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য থেকেই নবান্ন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শেষ দৃশ্যটি সম্পূর্ণই নবান্ন উৎসবের আনন্দে ভরা। সব হারিয়ে ফেলা মানুষগুলি গ্রামে ফিরে এসে কৃষক-শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘জোর প্রতিরোধ’এর সংকল্প গ্রহণ করেছে। নাটকটিতে এই তিমিরবিনাশী প্রত্যয় থাকার কারণেই এর নাম ‘নবান্ন’।

সেকালে এবং সর্বকালের বাংলা নাট্যজগতে ‘নবান্ন’ একটা ইতিহাস। কবিশেখর কালিদাস রায় বলেছিলেন, নাটকটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত, জ্বলন্ত কতকগুলি প্রাণস্পর্শী দৃশ্যের একত্র গ্রন্থন। সামগ্রিকভাবে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটকে আত্মস্থ করে নবান্ন যে কালোত্তীর্ণতা অর্জন করেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকগুলির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। নাট্যকার শম্ভু মিত্র মন্তব্য করেছিলেন, শ্রী বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটক যেন শ্মশানচারী ভৈরব শিবের মূর্তি। কোনও মিথ্যে নেই, কোনও ছলাকলা নেই

  • এরপর ১৯৪৬ সালে বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্য সংঘ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫০ সালে গড়ে তোলেন ক্যালকাটা থিয়েটার। রচিত হয় মরাচাঁদ, কলঙ্ক, জীয়নকন্যা, গর্ভবতী জননী, অবরোধ, দেবীগর্জন ইত্যাদি নাটক। ‘কলঙ্ক নামক একাঙ্ক নাটকটি বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতালদের আশানিরাশা-তাড়িত জীবনের পটভূমিতে রচিত। নাটকটির সমাপ্তি নেতিবাচক ধ্বংসে নয়, ইতিবাচক প্রতিরোধের সংকল্পে। মরাচাঁদ নাটকটি একজন সঙ্গীত শিল্পীর সঠিক পথদর্শনের কাহিনি। অন্ধ সঙ্গীত শিল্পী পবনের গান যেভাবে অগণিত শোষিত মানুষের জীবনের গান হয়ে উঠলো তাই বর্ণনা করা হয়েছে এই নাটকে। অবরোধ নাটকের মূল বিষয় মালিকপক্ষের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, নির্বিচার শ্রমিক শোষণ এবং প্রতিবাদী শ্রমিক আন্দোলনের প্রয়াস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ এই নাটকের পটভূমি। একাঙ্ক নাটক ‘কলঙ্ক’-কে অনুসরণ করে বিজন ভট্টাচার্য ১৯৬৬ সালে লেখেন পূর্ণাঙ্গ নাটক দেবীগর্জন। কলঙ্ক নাটকের কাহিনিকে অনুপঙ্ক্ষ বিস্তৃতিতে বর্ণনা করা হয়েছে এখানে।

মূল্যায়ন : 

  • বিজন ভট্টাচার্যের আবির্ভাব গতানুগতিক বাংলা নাট্যজগতে মুক্তি সংবাদের মতো তুমুল আলোড়ন এনেছিল।
  • গণনাট্য সংঘের প্রতিরোধের আদর্শ তাঁর বেশিরভাগ নাটকের মূল সুর। মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকেই তিনি নাটকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
  • তাঁর বেশিরভাগ নাটকেই উঠে এসেছে মন্বন্তর-পীড়িত বাংলার বেদনা ও জীবন সংগ্রাম এবং অধিকার অর্জনের লড়াই। নাট্যকার স্বয়ং বলেছিলেন, ‘নাটক রচনার পিছনে তাগিদ যেটা ছিল, সেটা হল এক জীবনযন্ত্রণা’।
  • তাঁর নাটকের সংলাপ সাধারণত মানুষের মৌখিক ভাষা অবল্মবনে রচিত। যে অঙচলের পটভূমিতে নাটকের কাহিনি সংস্থাপিত হত, সেই অঞ্চলের উপভাষা তিনি সংলাপ রচনায় ব্যবহার করতেন।
  • বাংলা নাটককে বাস্তবধর্মী করে তোলাই ছিল বিজন ভট্টাচার্যের সবচেয়ে বড় অবদান। তিনি নাটকের কাঠামো ধরে জীবনের দিকে এগোননি, জীবন থেকে নাটকের দিকে এগিয়েছেন। মঞ্চসত্য ও জীবনসত্যের মধ্যে এই সেতুবন্ধনেই নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব ও অনন্যতা।

 

  • গণনাট্য :
  • ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালে(১৯৪৩) কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সংগঠন হিসাবে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সের দার্শনিক রমাঁ রলাঁর পিপলস থিয়েটারের প্রভাব গণনাট্যের আদর্শে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি এই ধরনের থিয়েটারের বিশিষ্টতায় তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। প্রথমত, সাধারণ দর্শকের প্রাণের কথা তাঁদের সহজবোধ্য প্রমোদের মাধ্যমেই বলতে হবে। এই সাধারণ দর্শক হচ্ছে সর্বব্যাপক জনসাধারণ, শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয়ত, শুধু আনন্দ দেওয়া নয়, দর্শকদের উজ্জীবিত করে তাদের নতুন জীবনভাবনায় প্রাণীত করতে হবে। তাদের জীবন সমস্যা, তার কারণ এবং তা থেকে মুক্তির চিন্তা ও উপায় –সেগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পিপলস থিয়েটারকে নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই থিয়েটারকে উদ্দেশ্যমূলক হতে হবে। জীবনের আনন্দের মাধ্যমে দর্শককে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনাসম্পন্ন করার মধ্য দিয়েই এই থিয়েটারের সাফল্য।
  • ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের নাট্যভাবনার মধ্যে এই চিন্তা সূত্রগুলি কাজ করেছিল। সেখান থেকে যে ভাবনাগুলি তৈরি হল তা মোটামুটি নিম্নরূপ:

১। গণনাট্যের নাটকে কাহিনি আবর্তিত হবে জীবনের বাস্তব সমস্যাকে কেন্দ্র করে।

 ২। সেখানে থাকবে সে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ।

৩। গণনাট্য  প্রথাসিদ্ধ নাটকের নায়ক-মহিমাকে স্বীকৃতি দেয় না। একক নায়ক প্রাধান্যের পরিবর্তে এ নাটকে গোষ্ঠীর মূল্য অনেক বেশি।

৪। এ নাটকে নাট্যচরিত্রকে শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে দাঁড় করানো হয়।

 ৫। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং তাদের জমিদার ও মালিক শ্রেণির আসল স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়া এই নাটকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

৬। গণনাট্যে লোকায়ত মানুষের লোকাচরণ, লোকসংস্কৃতি, লোক্ক্রীড়া, লোকসংগীত, লোকাচার, লোকশিল্পের নানা দিক যত্নের সঙ্গে তুলে ধরা হয়।

৭। মঞ্চ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বহু অর্থ ব্যয়ে পেশাদারী মঞ্চ নির্মাণ কৌশলকে পরিত্যাগ করা হয়। অনেকসময় সাধারণ মানুষদের মাঝখানে গিয়ে এই নাটক অভিনয় করতে হয় বলে সামান্য উঁচু একটি সাধারণ মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। মঞ্চের পিছনে অনেক সময় শুধু মাত্র একটি পর্দা থাকে।

নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। গণনাট্য সংঘের জন্ম লগ্ন থেকেই তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর নাট্যভাবনায় গণনাট্যের বিপুল প্রভাবের কথা সর্বজনবিদিত।

সভ্যতার সংকটের স্বরূপ ও রবীন্দ্রনাথের আশাবাদ

‘সভ্যতার সংকট’ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রজন্মোৎসব উপলক্ষ্যে পুস্তিকা আকারে বিতরণ করা হয়েছিল। এই আশি-বর্ষ্পূর্তি উৎসবই রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব। নববর্ষের সায়াহ্নলগ্নে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে সমবেত আশ্রমবাসী ও অতিথি অভ্যাগতদের সমক্ষে পঠিত এই অভিভাষণই কবিজীবনের সর্বশেষ অভিভাষণ। কবির উপস্থিতিতে ক্ষিতিমোহন সেন সেদিন এই প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সত্যদ্রষ্টা কবির  বাস্তব জীবন-অভিজ্ঞতার শেষ স্বাক্ষর বহন করছে এই প্রবন্ধটি।

  • আশি বছর বয়স অতিক্রান্ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির জীবনে দেখেছেন সভ্যতার সংকট। মানব জাতির ইতিহাসে এই সভ্যতার সংকটে তিনি স্বভাবতই বিচলিত ও ক্রুদ্ধ। এই প্রবন্ধ যখন লিখছেন তিনি, তখন শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে ইউরোপের জ্ঞান ও বিজ্ঞান একদিন সমস্ত মানব জাতিকে পথ দেখাবে বলে ভাবা হয়েছিল, সেই ইউরোপ আজ সমস্ত পৃথিবীর বুকে ডেকে এনেছে ধ্বংসের তাণ্ডব। নিজেদের ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নখ-দন্ত বের করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষ সরাসরি এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও, ভারতবর্ষের উপরে যে এই সাম্রাজ্যবাদী লালসার ছায়া সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পড়েছে তা যুগদ্রষ্টা কবির পক্ষে বোঝা অসম্ভব হয়নি। দীর্ঘ দুশো বছর ধরে ভারতবর্ষ ইংরেজদের দ্বারা পদানত।
  • অথচ ইংরেজের এই অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী পরিচয়টুকুই সব ছিল না একসময়। ভারতবর্ষ তার দীর্ঘকালীন মধ্যযুগীয় অবশেষ ত্যাগ করে ইংরেজদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্পর্শেই নতুন করে জেগে ওঠার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। ইংরেজের মাধ্যমেই ভারতবাসী ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। তাদের সামনে খুলে গিয়েছিল এক নতুন আকাশ। সেই আকাশে কোথাও ছিল না সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কালো কঠিন মুখ। রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন এই প্রসঙ্গে। অল্প বয়সে তিনি যখন ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, সেখানের পার্লামেন্টে তিনি শুনেছিলেন জন ব্রাইটের বক্তৃতা। সেই বক্তব্যের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন চিরকালীন ইংরেজের বাণী। সেই বাণী মানবতার। সেই বাণী উদারতার। সেই বাণীর মধ্যে কোথাও জাতিগত সংকীর্ণতা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নিজের আত্মীয় হিসাবে গ্রহণ করার ঔদার্য ছিল সেই বাণীর মধ্যে। আর শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্রই যে শুধু ইংরেজরা আবিষ্কার করেছিল তা নয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন উদার মানবতার বাণী। শেক্সপীয়রের নাটক, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীটস, শেলির কাব্য, মেকলের প্রবন্ধ –সবকিছুর মধ্য থেকেই ভারতবাসী তাদের প্রাণের রস সন্ধান করেছিল।

তাই রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য, মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ চরিত্রে। তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম। ক্রমে ইংরেজ এ দেশের শাসক হয়ে বসেছে। বণিকের মানদণ্ড পরিণত হয়েছে শাসকের রাজদণ্ডে। তা সত্ত্বেও ইংরেজের প্রতি শ্রধার অনুভবটি অনেকের মনেই জাগ্রত ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এতো গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে’।

  • কিন্তু ইংরেজ সম্পর্কে এই শ্রদ্ধার বোধ বর্তমান পরিস্থিতিতে আর বজায় রাখা সম্ভব নয় বলেই মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিগত কয়েক দশক জুড়ে ইংরেজরা পৃথিবীর উপর যে অমানবিক তান্ডবলীলা চালিয়েছে তাতে তাদের অতীত গৌরব ধূলিসাৎ হয়েছে। জ্ঞানের অগ্রদূত হয়ে যারা ভারতবর্ষে এসেছিলেন, অচিরেই তাদের মধ্যে দেখা দিল বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ। মানবতার দূত হিসাবে যাদের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া, তারাই বিশ্বজুড়ে মত্ত হল মানবতা লঙ্ঘনের খেলায়।‘কালান্তর’ প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের এই চরিত্র-পরিবর্তন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয় মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্য নয়, আগুন লাগাবার জন্যে’।  ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদী শোষকের নির্লজ্জ লালসার পরিচয় তুলে ধরল। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখেছেন, প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কি অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে। দীর্ঘ প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতবর্ষ ক্রমশ হীনবল হয়েছে। জনগনের উপর নেমে এসেছে একের পর এক দুর্বিষহ অত্যাচার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পুরোমাত্রায় নষ্ট হয়েছে। সমগ্র ভারতবর্ষ ইংরেজের তথাকথিত সভ্য শাসনের জগদ্দল পাথর বুকে নিয়ে তলিয়ে পড়ে রইল নিরুপায় নিশ্চলতার মধ্যে। ‘সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র আমার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হল, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধহয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনোদেশেই ঘটেনি’। সভ্যতার বড়াই করে যে দেশ ও জাতি তাদের কাছ থেকে সভ্যনামধারী মানব আদর্শের এতোবড় নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ দেখে রবীন্দ্রনাথ স্তব্ধ হয়েছেন।
  • শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্ব-রাজনীতি পর্যালোচনায় রবীন্দ্রনাথ তুলে এনেছেন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সভ্যতাগর্বী ইংরেজ কি নিষ্ঠুর তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। চীনের অহিফেন যুদ্ধ (১৮৪০-৪২) তেমনই এক আগ্রাসন। চীনে ইউরোপীয় দেশগুলির অবাধ বাণিজ্য নিষিদ্ধ ছিল। এ সময় চীনে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসাবে আফিমের ব্যাপক চাহিদা ছিল। ইংরেজ বণিকেরা চোরাপথে চীনে প্রচুর পরিমাণে আফিম সরবরাহ করতে থাকে। এবং কালক্রমে তা চীনাদের নেশায় পরিণত হয়। আফিমের কুপ্রভাব থেকে দেশবাসীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ক্যান্টন বন্দরে ২০ হাজার পেটি আফিম বাজেয়াপ্ত করে (১৮৩৯) ধ্বংস করে চীনা সরকার। ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ সরকার এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে চীনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। চীন তা অগ্রাহ্য করলে শুরু হয় প্রথম অহিফেন যুদ্ধ। শক্তিশালী ব্রিটিশরা সহজেই চীনকে পরাজিত করে। স্পেন থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একই ভাবে ইংরেজেরা নিজেদের মানবতাবিরোধী কর্মধারাকে বজায় রেখেছে শক্তির মদমত্ততায়। অন্য দেশের সম্পদ লুঠ করে এনে নিজেরা হয়েছে সমৃদ্ধতর। ইংরেজকে অনুসরণ করে ফরাসী, ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপীয় জাতিরাও নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষকে লুণ্ঠনের খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের সেই লোভের কারণে ঘটে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অবক্ষয় দেখে মনে হয়েছিল এমন কালো সময় হয়তো আর পৃথিবীর বুকে কোনওদিন আসবে না। কিন্তু তা থেকেও ইংরেজ সহ ইউরোপের দেশগুলি কোনও শিক্ষা নেয় নি। শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ ধিক্কার দিয়ে লিখেছেন, এমন সময় দেখা গেল, সমস্ত যুরোপে বর্বরতা কিরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে  
  • কিন্তু, প্রবন্ধের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার এই সংকটকে তুলে ধরলেও, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের বিধ্বস্ত রূপ প্রকাশ করলেও, নিজের গভীর জীবনপ্রজ্ঞায় তিনি যেন অনুভব করেছেন এই ধ্বংসই মানব সভ্যতার শেষ কথা নয়। আজকের রক্তলেখা বাস্তব যে ইতিহাসের শিশুপাঠ্য কাহিনিতে স্থান পাবে এ তার স্থির বিশ্বাস। নিজের মানসচক্ষে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, ইংরেজের আসন্ন পতনের ভবিষ্যৎ। ইতিহাসের গভীর প্রজ্ঞায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে ইতিহাস সাক্ষী, বড় বড় অত্যাচারী শাসকেরা হাজার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের শুভবুদ্ধিরই জয় ঘটেছে। তেমনি ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনই শেষ কথা হয়ে থাকবে না। এ কথা ঠিক ইংরেজের অত্যাচারে ভারতবর্ষের অবস্থা আজ খুবই করুণ। কিন্তু ঔপনিষদিক চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, একদিন পাশ্চাত্যের এই লালসার সামনে প্রাচ্যের ত্যাগের বাণীই প্রাচীর হয়ে দেখা দেবে। এই বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য আবির্ভূত হবেন প্রাচ্যের মহামানব। বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের মতোই যথার্থ প্রজ্ঞার পথ উদ্ভাসিত হবে পৃথিবীর সামনে। ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্রলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই’। আর তাই এই প্রবন্ধের শেষ বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের চরম আশাবাদই ধ্বনিত হয়। মানব সভ্যতা বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজ এখানে এসে পৌঁচেছে। হয়তো বর্তমান খুব কঠিন, কিন্তু যখনই মানব সভ্যতা এই রকম কালবেলায় উপনীত হয়েছে, ততবারই উদিত হয়েছে নতুন ভোর। তাই রবীন্দ্রনাথ আশা রেখেছেন মানুষের শুভ চৈতন্যের প্রতি। ‘কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব’। প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা ও মদমত্ততা ও অহঙ্কার পরিণতিতে যে বিনষ্ট হবেই এই তাঁর গভীর বিশ্বাস। উপনিষদের বাণী উদ্ধৃত করে তাই তিনি বলেন, অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি… অর্থাৎ, অধর্মের দ্বারা মানুষ বাড়িয়া ওঠে, অধর্ম হইতে সে আপন কল্যাণ দেখে, অধর্মের দ্বারা সে শত্রুদিগকেও জয় করে। কিন্তু পরিশেষে একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায় 

     

In search of Fataruu’s in corona days

করোনার দিনগুলিতে ফ্যাতারুদের সন্ধানে

বইয়ের তাকে জ্বলজ্বল করছিল বইটা। নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘উপন্যাস সমগ্র’। দে’জ পাবলিশারের বই। নবারুণ ভট্টাচার্য আমার প্রিয় সাহিত্যিকদের একজন। অনেকেরই প্রিয়। ইতিমধ্যেই তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস  পড়া হয়ে গেছে। হারবার্ট  নামের উপন্যাসটি পড়েছিলাম সেই ছাত্রজীবনে। তখন থেকেই নবারুণ ঘোর ধরিয়ে দেয় মাথায় ।

সেই ঘোর বোধহয় এখনও কাটেনি। তারপর ফ্যাতাড়ু সিরিজের সেইসব অবিশ্বাস্য গল্প। স্বভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ফ্যাতাড়ুরা তখন কলেজ স্ট্রিটের মূল চর্চার বিষয়। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে চলেছে পুরন্দর ভাটের সেইসব কবিতা। সংসৃতি নাট্যদল মঞ্চস্থও করেছিল ফ্যাতাড়ু। মনে আছে একবার দেখে সাধ মেটেনি। পরে সুমন মুখোপাধ্যায় হারবার্ট সিনেমাও বানিয়েছিলেন। শুভাষিস মুখোপাধ্যায় হারবার্ট চরিত্রে বোধহয় জীবনের সেরা অভিনয়টি করেছিলেন।

  • তারপর এলো ‘কাঙাল মালসাট’। বিগত কয়েক দশকে এই ধরণের কোনও উপন্যাস লেখা হয়েছে কি বাঙলা সাহিত্যে? কিংবা এতো তুমুল আলোড়ন ও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে কি আর কোনও লেখা? খুব একটা কিছু মনে আসছে না। বাঙালির সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভণ্ডামির এতো নিপুণ পরিচয় এবং সেগুলিকে এভাবে ধরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী লেখক নবারুণ ছাড়া কয়জনই বা আছেন। কাঙাল মালসাটও সিনেমা হয়ে বেরোয়। এতো বহুস্তরীয় বর্ণণাভঙ্গিকে সিনেমার রিলে ফুটিয়ে তোলার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন আবার সেই সুমন মুখোপাধ্যায়। এরপর ইতস্তত পড়েছি যুদ্ধ পরিস্থিতি, লুব্ধক ইত্যাদি উপন্যাসও । অনেকদিন থেকেই মাথায় ঘুরছিল নবারুণের সব কটা উপন্যাস যদি একটানা পড়ে ফেলা যায়! কিন্তু দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে সেই অবকাশ খুব একটা ছিল না।
  • এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে গৃহস্থালির কাজকর্ম সেরে, ছয় বছরের ছোট্ট ছেলের নানা আবদার মিটিয়ে, ইউনিভার্সিটির অনলাইন কর্মযজ্ঞের শরিক হওয়ার পরেও তাই নবারুণের উপন্যাস সমগ্র হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। কিছুদিন আগেই কিনে আনা সেই বই ইতিমধ্যেই নাড়াচাড়া করে নিয়েছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু নবারুণ তো আর সহজপাঠ্য আর সহজপাচ্য কোনও বিষয় নয়। কিংবা ভাতের হাঁড়িও নয় যে একটা চাল টিপেই সব ভাতের ভিতরের খবর জেনে নেওয়া যাবে! কাজেই ডুব দেওয়াই মনস্থির করলাম।
  • একে একে আবার পড়ে ফেললাম হার্বাট, ভোগী, যুদ্ধপরিস্থিতি, খেলনা নগর, কাঙাল মালসাট, লুব্ধক, অটো, মসোলিয়ম। পড়ছিলাম আর বোঝার চেষ্টা করছিলাম নবারুণ আসলে কাদের কথা বলেন? কাদের প্রতি তার সমর্থন?
  • উপন্যাসে উপন্যাসে আসলে তিনি তুলে ধরছেন বহুদিন ধরে বঞ্চিত, বহুদিন ধরে ব্যবহৃত কিছু মানুষের কথা। না শুধু তাদের বঞ্চনার কথা নয়, হতাশার কথা নয়, সেইসঙ্গে সেই মানুষগুলো , দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া মানুষগুলো পালটা ষড়যন্ত্রে সামিল হচ্ছে অবশেষে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে, এই হিপোক্রাসির বিরুদ্ধে, মধ্যবিত্তের এই শান্ত শিষ্ট নাদুস-নুদুস নিরপেক্ষ সুযোগলোভী অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, উচ্চবিত্তের আর ক্ষমতাবানের বিশ্বাসঘাতকার বিরুদ্ধে, ইতিহাসের পাতায় নিজেদের অনুল্লেখের রাজনীতির বিরুদ্ধে।
  • কাঙাল মালসাট উপন্যাসে যেমন ফ্যাতাড়ু আর চোক্তারেরা মিলে ঘনিয়ে তোলে এক সশস্ত্র বিদ্রোহ। পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্রযন্ত্রই আসলে কোনওদিনই জানতে পারবে না সেই ভিতরে ভিতরে ঘনিয়ে ওঠা বজ্রগর্ভ মেঘের খবর। বৃহৎ সিস্টেমের বিরুদ্ধে জং ধরা দুটো তলোয়ার, হাতা, খন্তি, লাঠি কিংবা পর্তুগিজ আমলের মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা একটা নুনু-কামান নিয়ে সেই অসম যুদ্ধে চোক্তার আর ফ্যাতাড়ুরা নেমেছে হাসতে হাসতে, কার্নিভালের মেজাজে। ভাবছিলাম, করোনা ভাইরাসের এই সর্বগ্রাসী পরিস্থিতি যদি বেঁচে থাকতেন এখনো নবারুণ কেমন করে ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর লেখায়?
  • ভাবছিলাম আর আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কেই আন্দাজ করতে পারছিলাম কী অসম্ভব এক আখ্যান তৈরি করে দিতেন নবারুণ তার কলমের আঁচড়ে।
  • এই ভাইরাস-সংক্রমণ-কে কি চোখে দেখতেন তিনি? কিভাবে নির্মাণ করতেন এক যাদু-বাস্তবতা –যা আসলে বাস্তবেরই এক নিষ্করুণ চেহারা মাত্র। এখনও আমরা নিশ্চিত নোই কিভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি – তা কি প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট নাকি মানুষের বিজয়াকঙ্ক্ষার এক নির্মম পরিণতি।
  • এই আবছায়ার সুযোগ নিয়ে হয়তো তিনি দেখাতেন এই ভাইরাস আসলে ফ্যাতাড়ূ আর চোক্তারদের দীর্ঘকালব্যাপী সযত্নলালিত এক নাশকতার পরিকল্পনার রূপায়ণ মাত্র। মানুষ নামক অহঙ্কারী (তাই পতনোন্মুখ) জীবটির মুখে এ এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। এই দেখ তোমার লোভ, তোমার জয়ের আকঙ্খা, পৃথিবীর সব খাদ্য আর সব সব সম্পদে নিজের আধিপত্য স্থাপনের ইচ্ছায় ভরপুর তোমার অন্ধকার অবচেতন – আজ তোমায় কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে।
  • তারপর আবার ভাবি, সত্যিই কি নবারুণ দেখাতেন এই নাশকতা? তিনি তো চিরদিন সেইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হয়ে কথা বলেছেন। এই ভাইরাস-যুদ্ধে সেই মানুষরাই হয়তো এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী আমরা কিংবা উচ্চবিত্তরা তো এখনও দুবেলা ভালোমন্দ খেয়ে, ডালগোনা কফি কিংবা ছোটবেলার হামাগুড়ি দেওয়া ছবি আপলোড করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। নবারুণ হয়তো সেই মানুষদের হয়ে নির্মাণ করতেন কোনও আখ্যান যারা রুজি-রুটি হারিয়ে অনিশ্চিত বর্তমান ও আরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমি তাকিয়ে থাকি ছবিটার দিকে।
  • কিছুদিন আগেই সব খবরের কাগজে বেরিয়েছিল এমন এক ছবি। একদল মানুষ মিছিলের মতো চলেছে। সংঘবদ্ধ মিছিল নয়; ছত্রখান হয়ে যাওয়া মিছিল-যারা জানে কোথায় পৌঁছাতে হবে অথচ পৌঁছানো যাবে কি না যাদের জানা নেই। দেখতে ছিন্নমূল মানুষের মতো লাগছে ওদের। তাড়াহুড়োয় যেটুকু সম্বল গুছিয়ে নিয়েছে নাইলনের ব্যাগে কিংবা সিমেন্টের থলিতে কিংবা রেক্সিনের লম্বা ব্যাগে। যানবাহনহীন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে সবাই। কারও কাঁধে বাচ্ছা, কারও কোলে। কোনও কোনও বাচ্ছা পাল্লা দিয়ে হাঁটছে মা-বাবার সঙ্গে। হয়তো আরও হাঁটতে হবে- পঞ্চাশ মাইল কিংবা একশো মাইল বা আরও বেশি। একজীবনে মানুষকে অনেক অনেক হাঁটতে হয়। এই সত্যটাকে সহ্য করতে পারতেন কি নবারুণ ? তার ফ্যাতাড়ুরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদে এগিয়ে আসতো? পুরন্দর ভাটের কবিতা নিশ্চই খাদ্য, জল, আশ্রয়ের নিরাপত্তায় মোড়া আমাদের শান্তির গৃহকোণকে ব্যঙ্গ করতো।
  • না কি তিনি নির্মাণ করতেন এমন কোনও আখ্যান যা তিনি নির্মাণ করেছেন ‘ভোগী’ উপন্যাসে। এই সংকটে পরিত্রাণ হিসাবে এগিয়ে আসবে ভোগীর মতো কেউ। মানব সভ্যতায় এমন এক সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে, মানুষকে বাঁচাতে, মানুষের কল্যাণের জন্য নির্মোহ ভাবে যখন ভোগী নিজেকে উৎসর্গ করবে মৃত্যুর কাছে। তার সেই স্যাক্রিফাইস আবার পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলবে এই নিশ্চিত বিশ্বাসে সে হাসতে হাসতে মরে যাবে।

জানি, নবারুণ তার পূর্বের কোনও লেখারই অনুবর্তন করতেন না এই পরিস্থিতিতে।  সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনবেদ রচিত হত তার হাতে। কিন্তু ঠিক জানি, তিনি কলম ধরতেন এই পরিস্থিতিতে সবকিছু হারাতে বসা মানুষগুলোর জন্যই। যে মানুষগুলোর পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোই এখন আমাদের একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে হয়।   

Removing psychological distance in corona days and preparing for the future

করোনার দিনগুলিতে মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে আগামীর জন্য প্রস্তুতি      

বর্তমান বিশ্বে করোনা এক মহামারীর চেহারা নিয়েছে। পৃথিবীর সবকটি মহাদেশে এবং প্রায় দুশোটি দেশে এই মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে মারা গেছে লক্ষাধিক মানুষ। স্বাস্থ্য ও আর্থিক পরিকাঠামোয় উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি এবং আমেরিকাও করোনার মৃত্যুমিছিল সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। ভারতবর্ষও করোনা মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে লকডাউন শুরু করে দিয়েছে। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। আমাদের দৈনন্দিন রুটিনটাই এখন আমূল পালটে গেছে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত বহির্মুখী আমাদের যাপন এখন ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, দোকান-বাজার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সমন্বিত আমাদের যে জীবনযাপন তা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত কিংবা একেবারে বন্ধ। বন্ধ সিনেমা হল, বন্ধ ঝাঁ-চকচকে মল, বন্ধ খেলার মাঠ, বন্ধ কফিশপ বা চায়ের দোকান। এমনকি টিভি খুললে এখন পুরানো অনুষ্ঠানের কিংবা সিরিয়ালের সম্প্রচার। জীবনটা এতোদিন বন্ধুর বিয়ের বাজনার মতো সুরে বাজছিল এখন সহসা তাল গেছে কেটে। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছিল জীবন-গাড়ীর চাকা, এখন আচমকা ব্রেক। কিংবা এ যেন তুমুল এক আলো-উৎসব-আনন্দ আয়োজন থেকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত হওয়া অন্ধকূপে। নিজেকে ক্রমাগতই বহির্মুখী করে তোলার শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষ আমরা এখন নতুন করে শিখছি নিভৃত গৃহকোণও জীবনরক্ষার জন্য কতটা জরুরি।

 

  • মানসিক অবসাদ তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে। জীবনকে যেভাবে এতোদিন ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপভোগ করে এসেছি আমরা সহসা এক ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সবকিছু। ভাইরাসের মৃত্যুভয় যেমন একদিকে জাঁকিয়ে বসছে, সেইসঙ্গে যাপনের এই অনভ্যস্ত দায়ভার আমাদের ক্লান্ত করে তুলছে আরও বেশি। ফেসবুক বা যে কোনও সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বোঝা যাচ্ছে চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই লকডাউনের এই গৃহবাসের দিনগুলিকে বন্দিদশার সঙ্গেই তুলনা করছেন। করোনাপূর্ব দিনগুলির স্মৃতিভারে তারা আচ্ছন্ন। কিন্তু বাড়িতে থাকার এই দিনগুলোকে কি শুধু বন্দিত্বের সঙ্গেই তুলনা করা চলে?

 

  • একটু অন্যভাবেও তো অনুভব করা যায় এই দিনগুলোকে। এমনভাবে কাটানো যায় যাতে করোনার আতঙ্কও মনের উপর জেঁকে বসতে না পারে। কাদের সঙ্গে কাটাচ্ছি আমরা এই দিনগুলো? বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান-দাদু-ঠাকুমা –এদের সঙ্গেই তো! এরাই তো আমার পরিবার। আমার সবচেয়ে আপনজন। এদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারিনা বলেই তো করোনা-পূর্ব দিনগুলিতে আমরা আক্ষেপ করতাম, মনখারাপ করতাম। তাহলে এই প্রিয়জনদের সঙ্গে এই সময়টুকু তো আমরা উপভোগ করেই কাটিয়ে দিতে পারি। একটু ভেবে দেখতে পারি আমরা। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, ইঁদুর দৌড় –এসবের মধ্যে আমরা বোধহয় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করে এসেছি এই প্রিয়-মানুষগুলোকেই। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ভেবে নিয়ে এই সম্পর্কগুলোও যে আমাদের মনোযোগ দাবি করে, সময় দাবি করে সে কথা ভুলতে বসেছি। সবাই মনে করে দেখি তো শেষ কতদিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে একটা গোটা বেলা নির্ভেজাল আড্ডা দিয়ে কাটাতে পেরেছি। কোনও রেস্টুরেন্টে কৃত্রিম আলোয় নয়, কোথাও বেড়াতে গিয়ে নয়, নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায় নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা, ছোটোবেলার কথা নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে কেটে গেছে অনেকটা সময়। তারপর আচমকা হয়তো মা বলে উঠেছেন যে , এতো বেলা হয়ে গেল, ভাত বসানো হলো না। দাদুর ঘরের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে –শরীর ঠিক আছে কি না জিগ্যেস করা ছাড়াও আরও কত কিছু নিয়ে কথা বলা যেত একসময় মনে পড়ে? মনে পড়ে সুনীল গাভাসকার বড় ব্যাটসমান না শচীন তেন্ডুলকর এই নিয়ে খুব তর্ক হতো তোমার দাদুর সঙ্গে। শেষ কবে ঠাকুমার বয়সের ভারী শীর্ণ মুখের বলিরেখাগুলোয় শান্তভাবে হাত বুলিয়েছি –মনে পড়ে? যে ভাই বা দাদার সঙ্গে বর্তমানে স্বার্থবুদ্ধি পরিচালিত আমাদের এতো সংঘাত, যার সংস্পর্শ এড়াতে হয়তো বা কেউ কেউ উঠে এসেছি স্বামী-স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ানের শোভিত ফ্ল্যাটে –সত্যি কি মনে পড়ে না তার সঙ্গে কাটানো শৈশব ও কৈশোরের সেই সব প্রথম সবকিছু। হাতে এখন অনেক সময়। ফোন করা যায় তাকে একটা? ছোট হয়ে যাবো? না একেবারেই না বরং ভেঙে যাওয়া সেতুটা আবার গড়েও উঠতে পারে। 

 

  • আসলে আধুনিক এই যন্ত্রসভ্যতায় হাজার মাইল দূরের স্বল্প-পরিচিত ব্যক্তিকে আমরা অনায়াসে আপন করে নিই ভার্চুয়ালি, কিন্তু নিজের বাড়ির আরশিনগরের বাসিন্দার খবর রাখিনা। এটাই আমাদের বাস্তব। আমাদের নিউক্লিয়ার সন্ধ্যায় তাই শুধুই মনখারাপের রাগিণী বেজে চলে। লকডাউনে কাছের মানুষদের মাঝে বসেও নিজেদের বিষাদগ্রস্ত বলে মনে হয়। উপেন্দ্রকিশোরের রচনাসমগ্রটা টেনে বের করে এনে ছেলেমেয়েকে পড়ে শোনাই আসুন রামায়ণ কিংবা মহাভারতের কাহিনি অথবা টুনটুনির গল্প। স্বামী-স্ত্রী যে যার ফোনে অনাবশ্যক সোশাল মিডিয়ায় স্ক্রল না করে দেখি ফেলি পুরানো কিংবা নতুন কিছু সিনেমা।

 

  • বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকার যে অভ্যাস আধুনিকতা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে – করোনার দিনগুলিতে সেই নিয়ম ভেঙে একটু বের হয়ে আসি। আমাদের মধ্যবিত্ত মন আর মননের পুরানো মেজাজটা ফিরিয়ে আনি। নিজের ভয়গুলো, সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করি পরস্পরের সঙ্গে। তুমি ওসব বুঝবে না বলে মা-কে দূরে সরিয়ে না দিয়ে কাছে গিয়ে বসি। গল্প করি সবার সঙ্গে। নিজেকে প্রকাশ করি। অন্যের প্রকাশকে গুরুত্ব দিই। পরিবার মধ্যবিত্ত মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই শক্তির যাদু আমরা চর্চা আর মনোযোগের অভাবে হারাতে বসেছি। বাইরের পৃথিবী বিধ্বস্ত হচ্ছে।

 

  • বাড়িতে আইসোলেশনে বসে থাকা ছাড়া এখন আমাদের কিছুই করার নেই। করোনা-যুদ্ধে এটাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। সেই অবসরে আমাদের অন্দরমহলটিকে এখন আমরা আবার রঙচঙে করিয়ে নিতে পারি। সম্পর্কের রেখাগুলোর উপর জমতে থাকা ধুলো উড়িয়ে দিতে পারি সহজেই। আর তা পারলেই ঘরে থাকার এই দিনগুলো আর বন্দিদশা বলে মনে হবে না। বাইরের আলো যখন নিভে এলো তখন ভিতরের আলো জ্বালিয়ে রাখাই দরকার। সেই আলোর জোরেই আমারা উঠে দাঁড়াতে পারবো। করোনা মহামারী নিশ্চয়ই কেটে যাবে।

 

  • কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিমত আমাদের সামজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে এই ভাইরাস-হানার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব দীর্ঘদিন বজায় থাকবে। বিশ্বব্যাপী মন্দা গ্রাস করবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি খোয়াবে। দরিদ্ররা হারাবে তাদের শেষ সম্বলটুকু। কিসের জোরে আমরা সেই দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ে নামব? এই প্রিয় মানুষেরা, আত্মার আত্মজনেরাই সেই লড়াইয়ে আমাদের শক্তি জোগাবে। আমরা শক্তি জোগাবো তাদের।
Skip to content