Adamas University is going to organize ANVESHAN- Student Research Convention, an initiative of AIU on 17th and 18th January 2025.
Education

মাতৃভাষায় শিক্ষা ও শিক্ষালাভের উপকারিতা

একটি শিশু জন্মর পর প্রথম যে ভাষা শোনে এবং কথা বলা শুরু করে তা হল তার মাতৃ ভাষা। এই ভাষার প্রতি  বিশ্বাস ও আস্থা অপরিসীম। নিজের পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রভাবে জড়িয়ে থাকে এই ভাষা।  তাই প্রাথমিক স্তরে যখন অন্যান্য বিষয় প্রচলন করা হয় তখন যদি বিদেশি ভাষার কাঠিন্যকে পরিহার করে মাতৃভাষায় তা পড়ান হয় তাহলে হয়ত শিক্ষালাভের পদ্ধতি কিছুটা সহজ ও  আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। এ বিষয়ে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর লেখা “ শিক্ষা ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধটির কথা আলোচনা করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বৈজ্ঞানিক হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু দেশের শিকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ তিনি কোনওদিন হারিয়ে ফেলেননি। বিজ্ঞানী হয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর আত্যন্তিক আগ্রহ। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে প্রয়াস আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু নিয়েছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ এই আদর্শে বিশ্বাসী সত্যেন্দ্রনাথ আমাদের আলোচ্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান নামক প্রবন্ধেও সেই একই বিষয় উদাহরণ-সহ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।  

  • এক ব্যবহারিক সম্যস্যার সূত্র দিয়ে এই প্রবন্ধের সূচনা। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতায় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন ভারতীয় ছাত্রদের হাতে কলমে অভিজ্ঞতার অভাব ও ব্যর্থতা। প্রতি বছরই এই দেশ থেকে বেশ কিছু ছাত্র বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় , কারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে যায়। এরা বিদেশে যায় মূলত মেক্যানিকাল ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার নানা শাখায় শিক্ষা লাভের  জন্য। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায় ভারতীয় ছাত্রদের সেই প্রাথমিক শিক্ষার অভাব রয়েছে যা থাকলে তাদের পক্ষে বিদেশের আধুনিক কর্মপদ্ধতি দ্রুত আয়ত্ত করা সম্ভব হত। প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিক আমেরিকা প্রত্যাগত এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। উক্ত শিক্ষাবিদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ইঞ্জিন চালাতে বললে ভারতবর্ষের ছেলেরা ভয় পায় ও অস্বস্তি অনুভব করে। এর কারণ তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাব। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু মুখস্থই করতে শেখায়। ব্যবহারিক কোনও জ্ঞান অর্জন করায় না। অথচ প্রতিবছর আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসংখ্য ছেলে পাশ করে বেরোয়। কিন্তু হাতেকলমে শিক্ষার অভাবে সেই শিক্ষা কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে না। ফলে শিক্ষার প্রসারে আমাদের জাতীয় প্রয়াস আসলে অপচয়ের নামান্তর। তাই তিনি বলেছেন,  ‘কি বিপুল অপচয় আমাদের এই জাতীয় প্রয়াসের’।
  • এই প্রাথমিক প্রস্তুতি ও আত্মবিশ্বাসের অভাব তাঁর মতে অবশ্যই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ না করতে পারার কারণেই গড়ে উঠেছে। তাই তাঁর প্রস্তাব ‘ আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে’। নিজের দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেছেন, ছাত্রদের সঙ্গে মাতৃভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনাই বিজ্ঞানের প্রাথমিক বা উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য জরুরি। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের সপক্ষে কিছু যুক্তি সাজিয়েছেন তিনি।
  • প্রথমত, ছাত্রদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ়তর ভিত্তি স্থাপনের জন্য ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সমস্যার খোলাখুলি আলোচনা জরুরি ও তাদের এক সঙ্গ কাজ করা উচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও বিদেশী ভাষা এসে দাঁড়ালে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র অনেকসময়ই ঠিক মতো মনের কথা বলতে পারে না। এবং শিক্ষকও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে , ছাত্রকে যা বোঝাতে চ্যেছিলেন, সে তার সবটাই বুঝতে পেরেছে কিনা। সেক্ষেত্রে শিক্ষনীয় বিষয়ের অনুশীলন অপেক্ষা বিদেশী ভাষার অনুশীলনে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। তাতে সময় বাঁচানো তো দূরের কথা, সময়ের আরও অপচয় হবে। অর্থাৎ লক্ষ্য অপেক্ষা উপলক্ষ্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় শিক্ষণীয় বিষয়টি ছাত্রদের কাছে ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। ফলে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠবে না। তৃতীয়ত, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সহযোগিতার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে বিদেশী ভাষা। ফলে সম্মিলিত প্রয়াসে সমস্যা সমাধানে অসুবিধা সৃষ্টি হবে।

বিপক্ষে যুক্তি : মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সপক্ষে এই সব যুক্তি অবশ্যই সেদিনকার শিক্ষামহলে সাদরে গৃহীত হয় নি। সত্যেন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবের বিপক্ষে নানা বিরুদ্ধ যুক্তি উঠে আসতে থাকে। একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জানান যে, ভারতবর্ষের বহু প্রদেশ, সেখানে বহুবিধ ভাষা প্রচলিত। তাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আন্তর্জাতিক ইংরাজি ভাষার পরিবর্তে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহৃত হয় তাহলে বিদ্যায়তনিক চলাচল বা আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারের ফলে ভারতীয় সমাজে উগ্র প্রাদেশিক বোধও গড়ে উঠতে পারে, যা শিক্ষা ও সমাজ উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। এই দুই যুক্তি ছাড়াও অনেকে এটাও বলেছেন যে, বিদেশী ইংরাজি ভাষা নাকি আমাদের সংহতির সপক্ষে কাজ করছে এবং আমাদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পুনরাবিষ্কার এই ইংরাজি ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই প্রাদেশিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ বিশেষ কোনও প্রয়োজনীয় বিষয় নয়।    

বিপক্ষ যুক্তি খণ্ডন : কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই সব যুক্তিকে মানতে চাননি। তাঁর মতে ‘এই সব লোক এখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় আদর্শেই বিশ্বাসী’। সমসাময়িকতার বাস্তব চাহিদাকে তাঁরা স্বীকার করতে চান না। তাঁদের এই মানসিকতার পিছনে রয়েছে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের চোখে ক্ল্যাসিক চর্চা, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল, হিউম্যানিটিজ, ভাষা ও আইন শিক্ষাই আদর্শ। বিজ্ঞানের উপযোগিতা তাঁরা স্বীকার করলেও বিজ্ঞানীকে দেখেন সন্দেহের চোখে। তারা মনে করেন ভারতবর্ষের পুরানো আদর্শের স্থান নিতে পারে বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে এমন কিছুই নেই। রাষ্ট্রে সংস্কৃতি ও উদ্দেশ্যমুখীন জীবন গড়ে তোলা সম্ভব প্রাচীন দর্শনের ভিত্তিতেই। বিজ্ঞানের সেখানে বিশেষ প্রয়োজন নেই।

  • ভারতবর্ষের পণ্ডিতমহলের এই মানসিকতার ঘোরতর সমালোচনা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন প্রাচীনকাল থেকে ভারতবাসীর মনে যে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস রয়েছে তার ফলশ্রুতিই এই বিজ্ঞানবিরোধী মানসিকতা। তিনি বলেছেন নালন্দা বা তক্ষশীলার মতো ভারতবর্ষের প্রাচীন উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে পারলৌকিকতার চর্চা করা হত। ভারতীয় দার্শনিকতার মূল কথাই হল এই সমস্যাজর্জর পৃথিবীকে দুদিনের পান্থশালা ভেবে নিয়ে পার্থিব বিষয় সম্পর্কে উদাসীন থাকা। এই ঔদাসীন্যের কারণেই প্রাবন্ধিকের মতে ভারতীয়রা জাগভারতীয়কে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের উপরে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার পাঠ গ্রহণ করা উচিত’। দেশের উন্নতির জন্য সমস্যাকে জয় করা দরকার। সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে দার্শনিক ঔদাসীন্যে মোক্ষলাভের কথা বললে দেশ ক্রমশ আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে। তিক ব্যাপারে আধিপত্য হারিয়ে বারবার বিদেশী শক্তির হাতে পরাজিত হয়েছে, দাসত্ব শৃঙ্খল বরণ করেছে।

সত্যেন্দ্রনাথের মতে বিজ্ঞানই পারবে ভারতবর্ষকে আধুনিক পৃথিবীর প্রথম সারিতে স্থান করে দিতে। আর তাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চা করা দরকার। সেই আত্মবিশ্বাস একমাত্র মাতৃভাষার পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। অনেকের মতে ভারতীয় ভাষাগুলিতে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব বাধাসৃষ্টি করতে পারে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। সত্যেন্দ্রনাথের মতে পরিভাষার অভাবের ক্ষেত্রে ইংরাজি টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। ছাত্ররা যদি এই শব্দ সহজেই বোঝে তবে ধার করা শব্দ হিসাবেই তা টিকে থাকবে ও  সমৃদ্ধ করবে আমাদের জাতীয় শব্দভাণ্ডার। বহু বিদেশী শব্দ এভাবেই ভারতবর্ষের প্রাদেশিক ভাষাগুলিতে এর আগেও যুক্ত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে বিরোধিতার মানে নেই। তাছাড়া অনেকসময় বৈজ্ঞানিক শব্দের তর্জমা পণ্ডশ্রম মাত্র। রেলওয়ে, কিলোগ্রাম, সেন্টিমিটার, ব্যাকটেরিয়া –এই সব ভিন্ন ভাষার শব্দ সবাই বোঝেন ও ব্যবহার করেন। তাই এইসব প্রচলিত শব্দের পরিভাষা না খুঁজলেও চলে।  

Visited 4113 times, 3 Visits today

Skip to content