করোনার দিনগুলিতে মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে আগামীর জন্য প্রস্তুতি
বর্তমান বিশ্বে করোনা এক মহামারীর চেহারা নিয়েছে। পৃথিবীর সবকটি মহাদেশে এবং প্রায় দুশোটি দেশে এই মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে মারা গেছে লক্ষাধিক মানুষ। স্বাস্থ্য ও আর্থিক পরিকাঠামোয় উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি এবং আমেরিকাও করোনার মৃত্যুমিছিল সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। ভারতবর্ষও করোনা মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে লকডাউন শুরু করে দিয়েছে। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। আমাদের দৈনন্দিন রুটিনটাই এখন আমূল পালটে গেছে। প্রতিদিনের অভ্যস্ত বহির্মুখী আমাদের যাপন এখন ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, দোকান-বাজার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সমন্বিত আমাদের যে জীবনযাপন তা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত কিংবা একেবারে বন্ধ। বন্ধ সিনেমা হল, বন্ধ ঝাঁ-চকচকে মল, বন্ধ খেলার মাঠ, বন্ধ কফিশপ বা চায়ের দোকান। এমনকি টিভি খুললে এখন পুরানো অনুষ্ঠানের কিংবা সিরিয়ালের সম্প্রচার। জীবনটা এতোদিন বন্ধুর বিয়ের বাজনার মতো সুরে বাজছিল এখন সহসা তাল গেছে কেটে। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছিল জীবন-গাড়ীর চাকা, এখন আচমকা ব্রেক। কিংবা এ যেন তুমুল এক আলো-উৎসব-আনন্দ আয়োজন থেকে সরাসরি নিক্ষিপ্ত হওয়া অন্ধকূপে। নিজেকে ক্রমাগতই বহির্মুখী করে তোলার শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষ আমরা এখন নতুন করে শিখছি নিভৃত গৃহকোণও জীবনরক্ষার জন্য কতটা জরুরি।
- মানসিক অবসাদ তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে। জীবনকে যেভাবে এতোদিন ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপভোগ করে এসেছি আমরা সহসা এক ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সবকিছু। ভাইরাসের মৃত্যুভয় যেমন একদিকে জাঁকিয়ে বসছে, সেইসঙ্গে যাপনের এই অনভ্যস্ত দায়ভার আমাদের ক্লান্ত করে তুলছে আরও বেশি। ফেসবুক বা যে কোনও সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বোঝা যাচ্ছে চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই লকডাউনের এই গৃহবাসের দিনগুলিকে বন্দিদশার সঙ্গেই তুলনা করছেন। করোনাপূর্ব দিনগুলির স্মৃতিভারে তারা আচ্ছন্ন। কিন্তু বাড়িতে থাকার এই দিনগুলোকে কি শুধু বন্দিত্বের সঙ্গেই তুলনা করা চলে?
- একটু অন্যভাবেও তো অনুভব করা যায় এই দিনগুলোকে। এমনভাবে কাটানো যায় যাতে করোনার আতঙ্কও মনের উপর জেঁকে বসতে না পারে। কাদের সঙ্গে কাটাচ্ছি আমরা এই দিনগুলো? বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান-দাদু-ঠাকুমা –এদের সঙ্গেই তো! এরাই তো আমার পরিবার। আমার সবচেয়ে আপনজন। এদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারিনা বলেই তো করোনা-পূর্ব দিনগুলিতে আমরা আক্ষেপ করতাম, মনখারাপ করতাম। তাহলে এই প্রিয়জনদের সঙ্গে এই সময়টুকু তো আমরা উপভোগ করেই কাটিয়ে দিতে পারি। একটু ভেবে দেখতে পারি আমরা। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, ইঁদুর দৌড় –এসবের মধ্যে আমরা বোধহয় সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করে এসেছি এই প্রিয়-মানুষগুলোকেই। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ভেবে নিয়ে এই সম্পর্কগুলোও যে আমাদের মনোযোগ দাবি করে, সময় দাবি করে সে কথা ভুলতে বসেছি। সবাই মনে করে দেখি তো শেষ কতদিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে একটা গোটা বেলা নির্ভেজাল আড্ডা দিয়ে কাটাতে পেরেছি। কোনও রেস্টুরেন্টে কৃত্রিম আলোয় নয়, কোথাও বেড়াতে গিয়ে নয়, নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায় নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা, ছোটোবেলার কথা নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে কেটে গেছে অনেকটা সময়। তারপর আচমকা হয়তো মা বলে উঠেছেন যে , এতো বেলা হয়ে গেল, ভাত বসানো হলো না। দাদুর ঘরের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে –শরীর ঠিক আছে কি না জিগ্যেস করা ছাড়াও আরও কত কিছু নিয়ে কথা বলা যেত একসময় মনে পড়ে? মনে পড়ে সুনীল গাভাসকার বড় ব্যাটসমান না শচীন তেন্ডুলকর এই নিয়ে খুব তর্ক হতো তোমার দাদুর সঙ্গে। শেষ কবে ঠাকুমার বয়সের ভারী শীর্ণ মুখের বলিরেখাগুলোয় শান্তভাবে হাত বুলিয়েছি –মনে পড়ে? যে ভাই বা দাদার সঙ্গে বর্তমানে স্বার্থবুদ্ধি পরিচালিত আমাদের এতো সংঘাত, যার সংস্পর্শ এড়াতে হয়তো বা কেউ কেউ উঠে এসেছি স্বামী-স্ত্রী আর অ্যালসেশিয়ানের শোভিত ফ্ল্যাটে –সত্যি কি মনে পড়ে না তার সঙ্গে কাটানো শৈশব ও কৈশোরের সেই সব প্রথম সবকিছু। হাতে এখন অনেক সময়। ফোন করা যায় তাকে একটা? ছোট হয়ে যাবো? না একেবারেই না বরং ভেঙে যাওয়া সেতুটা আবার গড়েও উঠতে পারে।
- আসলে আধুনিক এই যন্ত্রসভ্যতায় হাজার মাইল দূরের স্বল্প-পরিচিত ব্যক্তিকে আমরা অনায়াসে আপন করে নিই ভার্চুয়ালি, কিন্তু নিজের বাড়ির আরশিনগরের বাসিন্দার খবর রাখিনা। এটাই আমাদের বাস্তব। আমাদের নিউক্লিয়ার সন্ধ্যায় তাই শুধুই মনখারাপের রাগিণী বেজে চলে। লকডাউনে কাছের মানুষদের মাঝে বসেও নিজেদের বিষাদগ্রস্ত বলে মনে হয়। উপেন্দ্রকিশোরের রচনাসমগ্রটা টেনে বের করে এনে ছেলেমেয়েকে পড়ে শোনাই আসুন রামায়ণ কিংবা মহাভারতের কাহিনি অথবা টুনটুনির গল্প। স্বামী-স্ত্রী যে যার ফোনে অনাবশ্যক সোশাল মিডিয়ায় স্ক্রল না করে দেখি ফেলি পুরানো কিংবা নতুন কিছু সিনেমা।
- বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো থাকার যে অভ্যাস আধুনিকতা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে – করোনার দিনগুলিতে সেই নিয়ম ভেঙে একটু বের হয়ে আসি। আমাদের মধ্যবিত্ত মন আর মননের পুরানো মেজাজটা ফিরিয়ে আনি। নিজের ভয়গুলো, সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করি পরস্পরের সঙ্গে। তুমি ওসব বুঝবে না বলে মা-কে দূরে সরিয়ে না দিয়ে কাছে গিয়ে বসি। গল্প করি সবার সঙ্গে। নিজেকে প্রকাশ করি। অন্যের প্রকাশকে গুরুত্ব দিই। পরিবার মধ্যবিত্ত মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই শক্তির যাদু আমরা চর্চা আর মনোযোগের অভাবে হারাতে বসেছি। বাইরের পৃথিবী বিধ্বস্ত হচ্ছে।
- বাড়িতে আইসোলেশনে বসে থাকা ছাড়া এখন আমাদের কিছুই করার নেই। করোনা-যুদ্ধে এটাই আমাদের একমাত্র অস্ত্র। সেই অবসরে আমাদের অন্দরমহলটিকে এখন আমরা আবার রঙচঙে করিয়ে নিতে পারি। সম্পর্কের রেখাগুলোর উপর জমতে থাকা ধুলো উড়িয়ে দিতে পারি সহজেই। আর তা পারলেই ঘরে থাকার এই দিনগুলো আর বন্দিদশা বলে মনে হবে না। বাইরের আলো যখন নিভে এলো তখন ভিতরের আলো জ্বালিয়ে রাখাই দরকার। সেই আলোর জোরেই আমারা উঠে দাঁড়াতে পারবো। করোনা মহামারী নিশ্চয়ই কেটে যাবে।
- কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিমত আমাদের সামজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে এই ভাইরাস-হানার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব দীর্ঘদিন বজায় থাকবে। বিশ্বব্যাপী মন্দা গ্রাস করবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি খোয়াবে। দরিদ্ররা হারাবে তাদের শেষ সম্বলটুকু। কিসের জোরে আমরা সেই দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ে নামব? এই প্রিয় মানুষেরা, আত্মার আত্মজনেরাই সেই লড়াইয়ে আমাদের শক্তি জোগাবে। আমরা শক্তি জোগাবো তাদের।
Visited 1605 times, 1 Visit today