আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘ
নিছক প্রমোদসর্বস্বতা থেকে জীবন সচেতনতার দিকে, রোমান্সের আড়ম্বর ও ভাবালুতা থেকে বাস্তব জীবনচেতনা সমৃদ্ধ শিল্পীত নাটকের দিকে প্রথম দিক নির্দেশ করে চল্লিশের দশকের ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলন। সেই গণনাট্য সংঘেরই পতাকাতলে দাঁড়িয়ে একসময়ে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও রঙ্গমঞ্চে আত্মনিয়োগ করেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। যে সময়ে বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বিজন ভট্টাচার্য নাটক লিখতে শুরু করলেন, সেই সময় শুধু ভারতে নয়, সমগ্র আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই এক চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৩১-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একদিকে বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী প্রভাব ও অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রবিপ্লবে বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত করাতে এবং এর থেকে উত্তরণের পন্থা জানানোর জন্য গণনাট্য সংঘ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলি আবর্তিত হয়েছিল জীবনের বাস্তব সমস্যাকে কেন্দ্র করে।
- ১৯৪৩ সালের মে মাসে গঠিত হয় ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’। বিজন ভট্টাচার্য সূচনার দিন থেকেই এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। সেই সময়, কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের সদস্যপদ গ্রহণের কিছু আগে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম নাটক ‘আগুন’ (১৯৪৩)। এই নাটক সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হওয়ার পরে রচনা করেন ‘জবানবন্দী’ (১৯৪৩) এবং বিখ্যাত ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) নাটক। এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে লিখলেন গীতিনাট্য ‘জীয়নকন্যা’ (১৯৪৭), শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘অবরোধ’ (১৯৪৭), সংগ্রামী শিল্পীর শপথের কাহিনি নিয়ে ‘মরাচাঁদ’ (১৯৪৬)। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত মতবিরোধ বাড়তে থাকায় তিনি ১৯৫০ সালে গঠন করেন নিজস্ব নাট্য সংস্থা ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তিনি সুনিপুণ ভাবে রচনা ও প্রযোজনা করেন ‘গোত্রান্তর’ (১৯৫৭), ছায়াপথ (১৯৬১), ‘দেবীগর্জন’ (১৯৬৬), ‘গর্ভবতী জননী’ (১৯৬৭) ইত্যাদি নাটক। ১৯৭০ সালে ক্যালকাটা থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি গঠন করলেন নতুন নাট্যদল ‘কবচকুণ্ডল’। প্রযোজনা করলেন ‘আজ বসন্ত (১৯৭০), ‘চলো সাগরে’ (১৯৭৭) ইত্যাদি নাটক। জীবন-প্রত্যয়ী নাটক রচনা ও উপস্থাপনার সংকল্পে আমৃত্যু অনমনীয় বিজন ভট্টাচার্য ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
- চল্লিশের দশকে দুর্ভিক্ষ , মহামারী, বন্যা বিপর্যস্ত বাংলাদেশে গণনাট্য সংঘের কর্মধারার বিস্তার ঘটে। এই প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক ‘আগুন’। এই নাটকটি পাঁচটি বিভিন্ন দৃশ্যের সমবায়ে গড়া স্কেচধর্মী রচনা। খাদ্যাভাব, রেশন ব্যবস্থায় দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমাগত বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতা এবং আসন্ন বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে এই নাটকে রূপ দিয়েছেন নাট্যকার। নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৯৪৩ সালের মে মাসে তৎকালীন নাট্যভারতী মঞ্চে।
- এর মধ্যে সামাজিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে গণনাট্য সংঘের কাছে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি পরিস্থিতির আরও তৎপর নাট্য-রূপায়ণ চাইলেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে রচিত হল তাঁর দ্বিতীয় একাঙ্ক নাটক ‘জবাননন্দী’। এই নাটকটিকে বিখ্যাত নবান্ন নাটকের প্রাক-খসড়া বলা যেতে পারে। এই নাটকে গ্রাম থেকে উৎপাটিত কৃষক জীবনের যে যন্ত্রণা রূপায়িত হয়েছে, নবান্ন নাটকে তারই বিস্তৃত প্রকাশ দেখা যায়। জবানবন্দী চারটি দৃশ্যে বিভক্ত। মহামারীতে বিপর্যস্ত, ক্ষুধার তাড়নায় গৃহহীন মানুষেরা শহরে এসে সেখানকার মানুষের নিস্পৃহতা, লোভ ও লালসার শিকার হয়। এই নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায়।
- বিজন ভট্টাচার্যের পরবর্তী যে পূর্ণাঙ্গ নাটকটি বাংলা নাটক ও নাট্য-অভিনয়ের ইতিহাসে এক পর্বান্তরের সৃষ্টি করেছিল, তা হল ‘নবান্ন’। তৎকালীন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এই নাটকটি রচনা করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভের সময় বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলে, তিনি যদি কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ না করতেন এবং ৪৪-এর মন্বন্তর না দেখতেন, তা হলে তিনি নবান্ন নাটক লিখতে পারতেন না। নবান্ন চার অঙ্কে বিন্যস্ত। প্রতিটি অঙ্ক আবার কয়েকটি করে দৃশ্যে বিভক্ত। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটি বর্ণিত হয়েছে আমিনপুর গ্রামের পটভূমিকায়, ৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের পুলিশি সন্ত্রাস, মহামারী, সাইক্লোন ইত্যাদির ছবি দিয়ে। দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় গ্রামীণ কৃষক প্রধান সমাদ্দার ও তার পরিবার অভাবের তাড়নায় শহরে এসে হাজির হয়েছে। এই ভাবে বিভিন্ন অঙ্কের বিভিন্ন দৃশ্যে তৎকালীন সাধারণ মানুষের নিদারুণ দুর্গতির ছবি বিজন ভট্টাচার্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু বিপর্যয়ই শেষ কথা নয়। মন্বন্তরের শেষে গ্রামে ফিরে এসে নতুন ধানের উৎসব নবান্নের মাধ্যমে নাটকটির সমাপ্তি। চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য থেকেই নবান্ন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শেষ দৃশ্যটি সম্পূর্ণই নবান্ন উৎসবের আনন্দে ভরা। সব হারিয়ে ফেলা মানুষগুলি গ্রামে ফিরে এসে কৃষক-শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘জোর প্রতিরোধ’এর সংকল্প গ্রহণ করেছে। নাটকটিতে এই তিমিরবিনাশী প্রত্যয় থাকার কারণেই এর নাম ‘নবান্ন’।
সেকালে এবং সর্বকালের বাংলা নাট্যজগতে ‘নবান্ন’ একটা ইতিহাস। কবিশেখর কালিদাস রায় বলেছিলেন, ‘নাটকটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত, জ্বলন্ত কতকগুলি প্রাণস্পর্শী দৃশ্যের একত্র গ্রন্থন’। সামগ্রিকভাবে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটকে আত্মস্থ করে নবান্ন যে কালোত্তীর্ণতা অর্জন করেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকগুলির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। নাট্যকার শম্ভু মিত্র মন্তব্য করেছিলেন, ‘শ্রী বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটক যেন শ্মশানচারী ভৈরব শিবের মূর্তি। কোনও মিথ্যে নেই, কোনও ছলাকলা নেই’।
- এরপর ১৯৪৬ সালে বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্য সংঘ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫০ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। রচিত হয় ‘মরাচাঁদ’, ‘কলঙ্ক’, ‘জীয়নকন্যা’, ‘গর্ভবতী জননী’, ‘অবরোধ’, দেবীগর্জন’ ইত্যাদি নাটক। ‘কলঙ্ক’ নামক একাঙ্ক নাটকটি বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতালদের আশানিরাশা-তাড়িত জীবনের পটভূমিতে রচিত। নাটকটির সমাপ্তি নেতিবাচক ধ্বংসে নয়, ইতিবাচক প্রতিরোধের সংকল্পে। ‘মরাচাঁদ’ নাটকটি একজন সঙ্গীত শিল্পীর সঠিক পথদর্শনের কাহিনি। অন্ধ সঙ্গীত শিল্পী পবনের গান যেভাবে অগণিত শোষিত মানুষের জীবনের গান হয়ে উঠলো তাই বর্ণনা করা হয়েছে এই নাটকে। ‘অবরোধ’ নাটকের মূল বিষয় মালিকপক্ষের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, নির্বিচার শ্রমিক শোষণ এবং প্রতিবাদী শ্রমিক আন্দোলনের প্রয়াস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ এই নাটকের পটভূমি। একাঙ্ক নাটক ‘কলঙ্ক’-কে অনুসরণ করে বিজন ভট্টাচার্য ১৯৬৬ সালে লেখেন পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘দেবীগর্জন’। কলঙ্ক নাটকের কাহিনিকে অনুপঙ্ক্ষ বিস্তৃতিতে বর্ণনা করা হয়েছে এখানে।
মূল্যায়ন :
- বিজন ভট্টাচার্যের আবির্ভাব গতানুগতিক বাংলা নাট্যজগতে মুক্তি সংবাদের মতো তুমুল আলোড়ন এনেছিল।
- গণনাট্য সংঘের প্রতিরোধের আদর্শ তাঁর বেশিরভাগ নাটকের মূল সুর। মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকেই তিনি নাটকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
- তাঁর বেশিরভাগ নাটকেই উঠে এসেছে মন্বন্তর-পীড়িত বাংলার বেদনা ও জীবন সংগ্রাম এবং অধিকার অর্জনের লড়াই। নাট্যকার স্বয়ং বলেছিলেন, ‘নাটক রচনার পিছনে তাগিদ যেটা ছিল, সেটা হল এক জীবনযন্ত্রণা’।
- তাঁর নাটকের সংলাপ সাধারণত মানুষের মৌখিক ভাষা অবল্মবনে রচিত। যে অঙচলের পটভূমিতে নাটকের কাহিনি সংস্থাপিত হত, সেই অঞ্চলের উপভাষা তিনি সংলাপ রচনায় ব্যবহার করতেন।
- বাংলা নাটককে বাস্তবধর্মী করে তোলাই ছিল বিজন ভট্টাচার্যের সবচেয়ে বড় অবদান। তিনি নাটকের কাঠামো ধরে জীবনের দিকে এগোননি, জীবন থেকে নাটকের দিকে এগিয়েছেন। মঞ্চসত্য ও জীবনসত্যের মধ্যে এই সেতুবন্ধনেই নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব ও অনন্যতা।
- গণনাট্য :
- ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালে(১৯৪৩) কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সংগঠন হিসাবে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রান্সের দার্শনিক রমাঁ রলাঁর পিপলস থিয়েটারের প্রভাব গণনাট্যের আদর্শে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি এই ধরনের থিয়েটারের বিশিষ্টতায় তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। প্রথমত, সাধারণ দর্শকের প্রাণের কথা তাঁদের সহজবোধ্য প্রমোদের মাধ্যমেই বলতে হবে। এই সাধারণ দর্শক হচ্ছে সর্বব্যাপক জনসাধারণ, শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয়ত, শুধু আনন্দ দেওয়া নয়, দর্শকদের উজ্জীবিত করে তাদের নতুন জীবনভাবনায় প্রাণীত করতে হবে। তাদের জীবন সমস্যা, তার কারণ এবং তা থেকে মুক্তির চিন্তা ও উপায় –সেগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পিপলস থিয়েটারকে নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই থিয়েটারকে উদ্দেশ্যমূলক হতে হবে। জীবনের আনন্দের মাধ্যমে দর্শককে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনাসম্পন্ন করার মধ্য দিয়েই এই থিয়েটারের সাফল্য।
- ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের নাট্যভাবনার মধ্যে এই চিন্তা সূত্রগুলি কাজ করেছিল। সেখান থেকে যে ভাবনাগুলি তৈরি হল তা মোটামুটি নিম্নরূপ:
১। গণনাট্যের নাটকে কাহিনি আবর্তিত হবে জীবনের বাস্তব সমস্যাকে কেন্দ্র করে।
২। সেখানে থাকবে সে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ।
৩। গণনাট্য প্রথাসিদ্ধ নাটকের নায়ক-মহিমাকে স্বীকৃতি দেয় না। একক নায়ক প্রাধান্যের পরিবর্তে এ নাটকে গোষ্ঠীর মূল্য অনেক বেশি।
৪। এ নাটকে নাট্যচরিত্রকে শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে দাঁড় করানো হয়।
৫। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং তাদের জমিদার ও মালিক শ্রেণির আসল স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়া এই নাটকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
৬। গণনাট্যে লোকায়ত মানুষের লোকাচরণ, লোকসংস্কৃতি, লোক্ক্রীড়া, লোকসংগীত, লোকাচার, লোকশিল্পের নানা দিক যত্নের সঙ্গে তুলে ধরা হয়।
৭। মঞ্চ ব্যবস্থাপনার মধ্যে বহু অর্থ ব্যয়ে পেশাদারী মঞ্চ নির্মাণ কৌশলকে পরিত্যাগ করা হয়। অনেকসময় সাধারণ মানুষদের মাঝখানে গিয়ে এই নাটক অভিনয় করতে হয় বলে সামান্য উঁচু একটি সাধারণ মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। মঞ্চের পিছনে অনেক সময় শুধু মাত্র একটি পর্দা থাকে।
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। গণনাট্য সংঘের জন্ম লগ্ন থেকেই তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর নাট্যভাবনায় গণনাট্যের বিপুল প্রভাবের কথা সর্বজনবিদিত।
Visited 3918 times, 2 Visits today