নাট্যকর্ম মানুষকে মহৎ থেকে মহোত্তর, শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর, পূর্ণ থেকে পূর্ণতর এবং শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর করে তোলে। সম্ভবত নাট্যশিল্প-ই সবচেয়ে বেশি সমাজ সম্পৃক্ত। সে সমাজকে বিশ্লেষন করে, ব্যাখ্যা করে, জনচেতনাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ইতিহাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত, নাট্যশিল্পের ভাঙাগড়া-ই নাট্যশিল্পের চলন। তার ক্রমবিবর্তনে নানা তত্ত্ব, রীতিনীতি ক্রমশ ডানা মেলেছে আপনধর্মে। কোনও নাট্যে যেমন পাওয়া গেছে দেশজ লৌকিক আঙ্গিকের প্রাধান্য, তেমন-ই কোনও নাট্য আবার ভাষার চমকপ্রদ খেলা। কোনও নাট্য সমাজ সচেতনতার দৃষ্টিতে পুষ্ট, আবার কখনো আত্মানুভবের কঠিন অথচ তীক্ষ্ম রসে দ্রবীভূত। কোনও নাট্য আবার, প্রথাবিরোধী প্রকরণের শিল্প-অভিজ্ঞান। এরকম প্রতি ক্ষেত্রেই, নতুন শৈলীর উন্মেষ ঘটেছে। মঞ্চবিন্যাস থেকে অলঙ্কারের কারুকৃতি – সবক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অভিনয়ের তাৎপর্য, ব্যাকরণ এবং প্রয়োগরীতি; সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে তৈরি হয়েছে নব্যধর্মী, স্বতঃস্ফূর্ত নাট্যদর্শন।
যেহেতু, নাট্যশিল্প একটি প্রায়োগিক কলা, তাই সেখানে এই নিরন্তর পরীক্ষার অবকাশ-কে অস্বীকার করার উপায় নেই, বরং চেষ্টা চলছে বিকল্প অনুসন্ধানের। প্রকরণগত দিক দিয়ে নাট্য উপস্থাপন-কে এনে ফেলা হয়েছে এক গবেষণাগারে। এরকমই এক সাম্প্রতিক পরীক্ষালব্ধ নাট্যআঙ্গিকের (মতান্তরে নাট্যদর্শন) নাম অন্তরঙ্গ নাটক বা Intimate Theatre।আসলে, ‘বিকল্প’ শব্দটার মধ্যেই একটা প্রতিস্পর্ধার গন্ধ পাওয়া যায় সেই সত্তরের দশক থেকেই বাদল সরকারের হাত ধরে ‘শতাব্দী’ নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে বাংলা নাটক প্রসেনিয়ামের গন্ডী অতিক্রম করে পাড়ি জমিয়েছিল নন-প্রসেনিয়ামের আঙিনায়। সেই শুরু, তারপর থেকে সমান্তরাল দুটি ধারা একসাথে চলেছে; পরস্পরকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানিয়ে। বিরোধ তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিরোধিতা করেনি কেউ কাউকেই। কারন, বাদল সরকারের শিক্ষা, থিয়েটার দর্শন এবং নাটককার হিসাবে অসামান্য দক্ষতা। শুধু বাদল সরকার নন, ভারতীয় থিয়েটারে তার অব্যবহিত পরেই চলে এসেছেন আরও একজন বিকল্পসন্ধানী থিয়েটার কর্মী সফদর হাশমি। অ্যাজিটপ্রপধর্মী পথ-নাটিকা থেকে বেশ কিছুটা আলাদা হয়ে বাদল সরকার এবং সফদর হাশমি পথে-অঙ্গনে বিকল্প থিয়েটারের নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ করলেন। ‘মিছিল’ থেকে ‘মেশিন’, ‘ভোমা’ থেকে ‘আওরত’ কিংবা ‘ভুল রাস্তা’ থেকে ‘হল্লাবোল’– কাতারে কাতারে মানুষ মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়েই থিয়েটারের মধ্যেই স্বাদ পেয়েছে মুক্তির, সাধ জন্মেছে বদলে দেবার।
থিয়েটারে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব? দুজনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সম্ভব? দর্শক কি নাট্যানুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে? নিষ্ক্রিয় দর্শককে কি সক্রিয় করা যায়? অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যেকার স্থানিক দূরত্ব ঘোচানো কি সম্ভব? প্রসেনিয়াম মঞ্চ, আলো, আবহসঙ্গীত, স্লাইড প্রজেকশন, সাউন্ড এফেক্ট, পোশাক, দৃশ্যপট, মঞ্চোপকরণ যাদের সম্ভব নয়, তাদের জন্য নাট্যাভিনয় কি সম্ভব নয়? এরপরও, বিপুল সমারোহের বাইরেও থিয়েটার ‘গণমাধ্যম’ হয়ে উঠতে পারে। আসলে অভিনেতা ও দর্শকের জীবন্ত উপস্থিতি ছাড়া থিয়েটার অসম্পূর্ণ। মঞ্চের অসমতলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে, একটি নির্দিষ্ট পরিশীলিত ঘরে অভিনয় অনুষ্ঠানকেই অন্তরঙ্গ থিয়েটার বলা সঙ্গত? মঞ্চোপযোগী সমস্ত উপাদান-উপকরণ নিয়ে, শুধুমাত্র সমতলীয় দর্শক সংস্থাপন হলেই অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় এ প্রশ্ন বহুদিনে।
প্রথাগত থিয়েটারে অর্থাৎ প্রসেনিয়াম থিয়েটারে কি অভিনেতা, অভিনয়ক্রিয়া এবং দর্শকের মধ্যে সম্পৃক্তিকরণ (প্রক্সিমিটি) গড়ে তোলা একেবারেই সম্ভব নয়? ত্রিমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পৃক্ত হয়ে থাকাই কি অন্তরঙ্গতার এক ও একমাত্র বিচার্য? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি বহুবার। বহুবার এমন মনে হয়েছে, একাডেমি কিংবা রবীন্দ্রসদনের শেষ রো-তে বসে কোনও নাট্যপ্রযোজনার কার্টেন কলের পরেও নিভৃতে কেঁদেছি একা একা। হয়তো সেই নাটকের শেষ দৃশ্য এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে, এমনভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি কখন নাটক শেষ হয়েছে! এমনই অন্তরঙ্গ হতে পেরেছি সেই নাট্যের সাথে, সেই অভিনেতার সাথে। কিন্তু, সবটাই ঘটেছে আমার একান্ত ব্যক্তিসত্ত্বায়। অন্ধকারে, মঞ্চ থেকে অনেকদূরের অসমতলে বসে, আমার ব্যক্তিগত চোখের জলটাও থেকে গেছে আমারই কাছে। নাটকের শেষে মনে হয়েছে, ঐ যে-মানুষটার চরিত্র ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী’র মতো আমার হয়ে গেছে, যাই তাকে গিয়ে প্রচন্ডভাবে জড়িয়ে ধরি, উজার করে দিই, সমর্পণ করি নিজেকে। আমার ‘বড়ো আমি’- টাকে কাছে এনে দেবার জন্য, ভিতরের সমস্ত তাপ-উত্তাপ বিনিময় করি তার সাথে। কিন্তু সম্ভব হয় কি? হতে পারে কি? সম্ভব নয়, জানি। আসলে সেই অভিনেতা আর আমার( দর্শকের) স্থানিক দুরত্ব থেকেই তৈরি হয়ে যায় বোধ, মনন আর হৃদয়ের মধ্যকার হাজার যোজন দূরত্ব। যে অভিনয় স্কিল আমাকে মুগ্ধ করেছে, তা আসলে জাস্ট একটা পারফর্মেন্স ছাড়া আর কিছুই না। ফলত, নাটকের শেষে আমার উক্ত হর্ষ, বেদনা, ক্ষোভ, অভিমান, ক্রোধ কিংবা ভালোবাসা- সবই তার (অভিনেতা) কাছে অনুভূতিহীন, মূল্যহীন, উত্তাপহীন একটা অনাগ্রহের চর্চা ব্যতীত কিছুই নয়। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, এই অন্তরঙ্গতাও তো আসলে একধরনের ফ্যান্টাসি। সিনেমা হল থেকে আসার সময় যে সুখানুভূতি, তার সাথে এই অন্তরঙ্গতার কোনও পার্থক্য নেই। দুটো ক্ষেত্রেই ক্ষণিকের অন্তরঙ্গ হবার একটা চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি।
কিন্তু অপর দিকে নন-প্রসেনিয়ামের আঙিনায় অভিনেতা – দর্শক একাত্ম হতে পারে অতি সহজেই। যে আমি একাডেমি বা রবীন্দ্রসদনে প্রসেনিয়ামের নাটক দেখে মনের মুগ্ধতা আর অভিনেতার সাথে স্থানিক দূরত্বকে সঙ্গী করে অন্তরঙ্গ হবার বদলে একটা চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি নিয়ে বাড়ি ফিরি সেই আমিই আবার কখনও শিয়ালদার লোরেটো-হাউসে কখনও নাকতলার নিরঞ্জন সদনে আবার কখনও বা বাংলা একাডেমির সামনের চাতালে দর্শকাসন থেকে সরাসরি উঠে গেছি ‘মিছিল’-এর জনতায়, কখনও বা হয়ে গেছি ‘মুক্তধারা’র শ্রমিক – গ্রামবাসীর অভিনেতা হিসেবে। আবার পরমুহূর্তেই ফিরে গেছি নিজের দর্শকাসনে। এখানে তো কোনো অসুবিধা হয়নি অভিনেতার সাথে একাত্ম হতে, অন্তরঙ্গ হতে। অন্তরঙ্গ থিয়েটার আসলে একটা মনন-কে আশ্রয় করে নির্মিত হয়। Audience-Performer-Space-Togetherness, — এই সমন্বয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয় অন্তরঙ্গ থিয়েটারকে। এক নিবিড় অনুশীলন এর ভিত্তি। স্পষ্ট বিশ্বাস, স্পষ্ট বিষয় এবং স্পষ্ট সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিয়েই অন্তরঙ্গ নাটকের পথ চলা। আসলে, থিয়েটার বরাবর-ই সময়ের কাছে দায়বদ্ধ। সময়ের দাবি মেনেই তাকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দর্শনে প্রকাশিত হতে হয়েছে বারবার। তাই, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতোই, থিয়েটারেরও একটা স্পর্ধা আছে। প্রথাগত যা কিছু, তাকে সে ভাঙতে চায়, বদলাতে চায়। বিকল্পের সন্ধান, সে করবেই। আর এই বিকল্পের খোঁজ মানে আসলে বিষয় অনুসন্ধান, আর তার সাথে পূর্বে কথিত Audience-Performer আর Space-এর অনুসন্ধান। এই Togetherness-এর সাথে হৃদয়ের তাপ-উত্তাপ আদান-প্রদানের খোঁজ, এই থিয়েটারের পাথেয়। ফলে, বিকল্প অনুসন্ধানে অন্তরঙ্গ তো হতেই হবে। অন্তরঙ্গ না হলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা অসম্ভব। বিকল্প মানেই সে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট -এর বাহক, নতুনের দিশারী।
বিকল্প থিয়েটার চর্চার জন্য বাদল সরকার থেকে রিচার্ড শেখনার প্রমুখেরা যে অন্তদর্শন নিয়ে ভাবতে চেয়েছিলেন তা আজকের অন্তরঙ্গ থিয়েটারে অনুপস্থিত। আসলে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় অন্তর থেকেই। অন্তরের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হতে হতে। যে প্রশ্নে মিলে যায় নাটককার থেকে নির্দেশক, অভিনেতা থেকে দর্শক। এক সামগ্রিক ঐকচেতনায় দ্রবীভূত হয়ে নতুনের সন্ধান পাওয়া যায়। গড়ে ওঠে বিকল্প নাটক; অন্তরঙ্গ নাটক। তাই অন্তরঙ্গতা থাকুক আমাদের অন্তরে, অন্তরতম হয়ে সবার মধ্যে।।
Visited 2378 times, 2 Visits today