সামাজিক যোগসূত্র (সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং): একটি কার্যকরী যোগযোগের মাধ্যম
সামাজিক যোগসূত্র (সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং) হল এমন একধরনের কার্যকলাপ যা বিশেষত ইন্টারনেটের সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও ব্যক্তিগত বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে অন্যদের সাথে ব্যক্তিগত ও ব্যাবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে । বর্তমানে, সামাজিক যোগসূত্র সাইটের ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে । 1994 খ্রিস্টাব্দ থেকে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগসূত্রভিত্তিক কার্যকলাপ GeoCities নামক ওয়েবসাইট দিয়ে শুরু হয় যা ব্যবহারকারীগণকে তাদের প্রোফাইল ও বন্ধুর তালিকা তৈরি করতে অনুমতি দেয় । উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, সক্রিয় সামাজিক যোগসূত্র সাইটের সংখ্যা প্রায় 250 ছাড়িয়ে গেছে ।
- 1971 খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথমবারের মত ই-মেইল প্রেরণ করা সম্ভব হয়েছিল ঠিক তখন থেকেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের জন্ম । পরবর্তীকালে, 1978 খ্রিস্টাব্দে, বুলেটিন বোর্ড পরিষেবা বা BBS গঠিত হয় । এই প্রযুক্তিতে ব্যক্তিগত কম্পিউটার থেকে ব্যবহারকারীরা মডেমের সহায়তায় ডায়ালের মাধ্যমে একটি হোস্ট কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হয়ে অন্যান্য ব্যবহারকারীদের ফোন লাইনের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় করত । বিবিএস হল প্রথম সিস্টেম যা ইন্টারনেটের সহায়তায় ব্যবহারকারীদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ প্রদান করেছিল ।
- ঠিক তার পরের বছর, প্রথম ওয়েব ব্রাউজার তৈরি হয় যা Usenet-এর মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করত । জিম এলিস এবং টম ট্রাসকট (Jim Ellis & Tom Truscott) Usenet তৈরি করেন যার দ্বারা ব্যবহারকারীরা খবর, প্রবন্ধ এবং মজার জিনিস একে অপরের সাথে আদান-প্রদান করতে পারত । বিবিএস এবং ফোরামের মত, Usenet-এ কোনো ‘কেন্দ্রীয় সার্ভার’ ছিল না । Usenet-এর এই ধারণায় বর্তমানে ‘Group’ ভিত্তিক সামাজিক যোগসূত্র সংক্রান্ত সাইটের (যেমন – Yahoo! Groups, Google Groups and Facebook Groups) তাত্ত্বিক ধারণা প্রদান করেছিল ।
- 1988 খ্রিস্টাব্দে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিংয়ের ধারণার জন্ম হয় যা আইআরসি বা ইন্টারনেট রিলে চ্যাট (IRC or Internet Relay Chat) নামে পরিচিত । আইআরসি তখন ইউনিক্স ভিত্তিক ছিল । যার ফলে এই ধরনের সুবিধা শুধুমাত্র কিছু লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
- 1994 খ্রিস্টাব্দে , প্রথম জিওসিটিস (GeoCities) নামে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট তৈরি করা হয়েছিল । জিওসিটিস সর্বপ্রথম ব্যবহারকারীদের নিজ্স্ব ওয়েব সাইট তৈরি করার অনুমতি দিয়েছিল । ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ 1995 খ্রিস্টাব্দে com নামে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জন্ম হয় । এটি বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব বিষয়বস্তু ও চিন্তাধারা প্রকাশের ক্ষমতা প্রদান করত । পরবর্তীকালে আরো বেশ কিছু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের জন্ম হয় । সেইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হল – Classmates, Friendzy, Hi-5 ইত্যাদি ।
- দুই বছর পরে, 1997 খ্রিস্টাব্দে এওএল ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার (AOL Instant Messenger) এবং com নামে দুটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং পরিষেবা চালু হয় । ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ব্যবহারকারীদের নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি করতে ও বন্ধুদের সাথে চ্যাট করার স্বাধীনতা প্রদান করেছিল । এওএল ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার (AOL Instant Messenger)কে বর্তমানের সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির অগ্রদূত হিসাবে পরিগণিত করা হয় । এই সাইটে একজন ব্যবহারকারী তার প্রোফাইলে নিজের সম্পর্কে কিছু লেখার সুযোগ পেত এবং সেই লেখাটিকে সবার সাথে শেয়ার করতে পারত । এই পরিষেবায়, ব্যবহারকারীরা খুব সহজেই অন্যের প্রোফাইল খুঁজে পেতে পারত । এইগুলি সেই সময়ের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য ছিল ।
- 1997 খ্রিস্টাব্দে Asian Avenue প্রতিষ্ঠিত হয়, 1999 খ্রিস্টাব্দে Black Planet প্রতিষ্ঠিত হয় এবং 2000 খ্রিস্টাব্দে হিস্পানিক সার্ভারের জন্য com প্রতিষ্ঠিত হয় । প্রথম আধুনিক সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট হল ফ্রেন্ডস্টার (Friendster) । এটি প্রধানত একটি ডেটিং সাইট ছিল । প্রথম 3 মাসেই, ফ্রেন্ডস্টার 3,000,000 ব্যবহারকারীদের একত্রিত করতে পেরেছিল । ঠিক কিছুদিন পরেই, মাইস্পেসের (MySpace) জন্ম হয় । মাত্র 10 দিনের কোডিং-র পর এই সাইটটিকে চালু করা হয়েছিল । এটি খুবশীঘ্রই ফ্রেন্ডস্টার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । মাইস্পেস ফ্রেন্ডস্টারের চেয়েও ব্যবহারকারীদের বেশি স্বাধীনতা প্রদান করেছিল যেখানে ব্যবহারকারীদের অডিও ও ভিডিও তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা ছিল ।
- সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের যুগে আর একটি মাইল ফলক হল LinkedIn । এটি 2003 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এটি সাধারণত পেশাদারী এবং ব্যবসায়িক কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছিল । বর্তমানে, LinkedIn-এর সদস্য সংখ্যা প্রায় 30 মিলিয়ন । পরবর্তীকালে, 2004 খ্রিস্টাব্দে Orkut ও Facebook এবং 2005 খ্রিস্টাব্দে Yahoo!360 প্রতিষ্ঠা লাভ করে । 2006 খ্রিস্টাব্দে Twitter-এর জন্ম হয় ।
Web 2.0-এর ব্যবহারের দ্বারা যে সব বিভিন্ন ধরনের ধারণা ও পরিষেবা পাওয়া যায় তার মধ্যে সামাজিক যোগসূত্র বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং অন্যতম । বয়েড ও এলিসান (Boyd & Ellison)-দের মতে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং হল ওয়েব নির্ভর পরিষেবা যা ব্যক্তিদের নিন্মলিখিত বিষয়গুলির অনুমতি দেয় – ক) একটি আবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে পাবলিক (Public) বা সেমি-পাবলিক (Semi-Public) প্রোফাইল গঠন , খ) যেসব ব্যবহারকারীগণের সাথে তথ্যের বা মতামতের আদান-প্রদান করা হয় তার একটি তালিকা তৈরি এবং গ) অন্যান্য ব্যক্তিগণ কর্তৃক তৈরি করা যোগাযোগকারী ব্যক্তিদের তালিকা দেখা ও বিচরণ করা ।
2004 খ্রিস্টাব্দে টিম ও’রেইলি ও ডেল দৌগহের্ট (Tim O’Reilly and Dale Doughert) Web 2.0 আবিষ্কার করার পর থেকেই ওয়েব ভিত্তিক কমউনিটি তৈরি ও ওয়েব হোস্ট করা মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান শুরু হয় । সাধারণভাবে, Web 2.0 বলতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের একটি নতুন ধারাকে বোঝানো হয়ে থাকে । এই নতুন ধারাটি বেশ কয়েক বছর থেকে প্রসার লাভ করেছে । এই ধারার মূল লক্ষ্য হল ওয়েবের সৃজনশীলতা, পারস্পরিক যোগাযোগ, নিরাপদ তথ্য আদান-প্রদান, সহযোগিতা এবং কার্যক্ষমতাকে বৃদ্ধি করা । এই নতুন ধারা ওয়েবে বেশ কিছু নতুন সাংস্কৃতিক ও কারিগরি সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছে । এর মধ্যে বিভিন্ন হোস্টিং পরিষেবাও রয়েছে । এই নতুন সম্প্রদায় ও সেবাগুলির মধ্যে আছে সামাজিক নেটওয়ার্কিংভিত্তিক ওয়েবসাইট, ভিডিও ওয়েবসাইট, উইকি, ব্লগ এবং ফোকসোনমি । Web 2.0-এর মাধ্যমে ওয়েবের একটি নতুন সংস্করণের কথা বলা হলেও এটা আসলে নতুন কোন সফ্টওয়্যার প্লাটফর্ম বা কারিগরি বিষয়ে নতুন কোন প্রজন্মকে নির্দেশ করে না । অর্থাৎ কারিগরি দিক দিয়ে Web ও Web 2.0-এর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই । পার্থক্য আছে শুধু ব্যবহার এবং উপযোগিতায় । টিম ও’রেইলির মতে, Web 2.0 is the business revolution in the computer industry caused by the move to the Internet as a platform, and an attempt to understand the rules for success on that new platform.
Web 2.0 প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে । যেমন – ওয়েব ব্লগস (Web Blogs), সোশ্যাল বুকমার্কিং (Social Bookmarking), উইকিস (Wikis), পডকাস্টস (Podcasts), সোশ্যাল সফ্টওয়্যার (Social Software), ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (Web Application Programming Interface) ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহারকারীগণকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে ।
2008 খ্রিস্টাব্দে Ofcum কর্তৃক ‘Social Networking: Quantitative and Qualitative Research Report into Attitudes, Behaviours and Use’ নামে একটি রিপোর্ট পেশ করা হয় । এই রিপোর্ট-এ সব ধরনের সামাজিক যোগসূত্র ব্যবহারকারীদের আচরণ ও মনোভাব অনুযায়ী পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । সেইগুলি হল –
যে সকল মানুষজন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিকে ব্যবহার করেন না তাদেরও সাইটগুলিকে না ব্যবহার করার কারণের উপর ভিত্তি করে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । সেইগুলি হল –
একটি কার্যকরী যোগযোগের মাধ্যম হিসাবে সামাজিক যোগসূত্র (সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং) সাইটগুলি নিন্মলিখিত কাজগুলি করে থাকে –
- বিশ্বব্যাপী সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে একটি পরিবারে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে ।
- Online resource তৈরিতে সাহায্য করে থাকে ।
- জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়াকে সচল রাখে ।
- ব্যক্তিকে অন্যান্য দেশের ব্যক্তিদের সাথে তার নিজস্ব চিন্তাধারাকে প্রকাশ করার সুযোগ প্রদান করে থাকে ।
- একই ধরনের রুচি ও ইচ্ছাযুক্ত মানুষদের খুঁজতে সাহায্য করে থাকে ।
- দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করতে সাহায্য করে ।
- যে সব ব্যক্তিরা একটু লাজুক প্রকৃতির হয় তাদের নিজস্ব ব্যক্তিসত্তাকে প্রকাশের সুযোগ করে দেয় ।
- বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা এই ধরনের সাইটগুলিতে তাদের নিজস্ব পণ্যগুলির বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন যার দ্বারা ওই সাইটগুলি ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা ওই পণ্যগুলি সম্পর্কে জানতে পারেন ।
- এই ধরনের সোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির পেশা অনুসন্ধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করে থাকে ।
- এই সাইটগুলিতে খুব সহজেই কোন একটি বিষয়ভিত্তিক event তৈরি করে সেই সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের মতামত পাওয়া যায়, যার দ্বারা ওই বিষয় সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণার
জন্ম হয় ।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার ফলে যোগাযোগকারী ব্যক্তিদের একটি ডোমেইন তৈরি হয়ে যায় এবং ওই ডোমেইনের অন্তর্গত ব্যবহারকারীদের প্রোফাইল দেখা ও মতামত আদান-প্রদান করা সম্ভবপর হয় । সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল এই সাইটগুলি অপরিচিত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ করার অনুমতি প্রদান করে থাকে এবং একইসাথে একজনের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ও ইচ্ছা প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় । এই ধরনের সাইটগুলি মানুষের জীবনের কিছু আদর্শকে অনুমান করে তৈরি করা হয় যেখানে মানুষ একে অপরের সাথে কিভাবে পরিচিত হতে পারে তার উপর ভিত্তি করে যোগসূত্র কাঠামো গড়ে ওঠে ।
Visited 2289 times, 1 Visit today