বাংলা লিখতে গিয়ে আর পাঁচটা ভাষার মতোই বানান নিয়ে সমস্যা লেগে থাকে। তবে যাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাদের ঠিক বানান লেখার দায় অনেক বেশি। ‘আম্ব্রেলা’-কে ‘আমরেলা’ বললে যতটা শোরগোল পড়ে, বাঙালিদের কাছে তার চেয়েও বেশি কষ্টের হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপনের কুৎসিত বাংলা বানান। পরীক্ষার্থীদের জন্য বানান ভুলে নম্বর কাটা এখন আর প্রযোজ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন কি শুধু নম্বরের? নির্ভুল ভাষা লিখতে পারা তো ভাষাশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই রইল কিছু নিয়ম, যাতে চোখ বুলিয়ে নিলে অন্তত কিছু সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
- ‘কী’ হল ইংরেজির ‘হোয়াট’। বাকি সমস্ত ক্ষেত্রে ‘কি’ বসে। যেসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না-তে দেওয়া সম্ভব, সেই ক্ষেত্রে ‘কি’ হবে। আর যে প্রশ্নের উত্তর বিস্তৃত, সে ক্ষেত্রে হবে ‘কী’। যেমন – ‘আমি কি খাব?’ এর উত্তরে হবে ‘হ্যাঁ, খাবে’ কিংবা ‘না, খাবে না’। কিন্তু ‘আমি কী খাব?’-র উত্তর একটা গোটা মেনুকার্ড হয়ে যেতে পারে!
- ‘কী সুন্দর!’ বা ‘কী খারাপ’ প্রভৃতি সবসময় ‘কী’। যে কোনও আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্বরের ব্যবহার হয়। ‘এমনকি’ হ্রস্ব স্বর। কিন্তু ‘কী এমন ব্যাপার’ দীর্ঘ।
- শব্দের শেষে বা শুরুতে অকারণ ঈ-কার, ঊ-কার, ও-কার বর্জন করা হয়। দিঘি, পাখি, বাড়ি, উনিশ। শুধু তখনই ও-কার বসে, যখন আমাদের অন্য কোনও প্রচলিত শব্দের সঙ্গে গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন – বলত। হত। করত। পারত। বলব। এবার মনে হতেই পারে যে ‘হত’ মানে তো নিহতও হয়। কিন্তু শব্দটি তুলনায় কম প্রচলিত। সেই কারণেই আমি ‘ভাল’ লিখি, ‘ভালো’ নয়। কিন্তু ‘কালো’-কে ‘কাল’ লেখা যাবে না। তাহলে আজ-কাল-এর সঙ্গে গুলিয়ে যাবে।
- ‘মত’ হচ্ছে মতামত। ‘মতো’ হচ্ছে সাদৃশ্যমূলক।
- কাপড় ‘পরা’। কারণ এটি ‘পরিধান’ থেকে এসেছে। ‘পঠন’ অর্থে ‘পড়া’, ‘পতন’ অর্থেও তাই।
- হাসি, কাচ, ইট – এগুলিতে চন্দ্রবিন্দু হয় না।
- ‘বাধা’ মানে বিপত্তি, অথবা বেধে যাওয়া। ‘বাধানো’ শব্দটা ঝগড়া বাধানো, গোলমাল বাধানো অর্থে বসে। ‘বাঁধা’ এসেছে বন্ধন থেকে। এর মানে ‘টু টাই আপ’। আর ‘বাঁধানো’ বসে দাঁত বাঁধানো, বই বাঁধাই, সোনা বাঁধানো এইসব ক্ষেত্রে।
- ‘বেড়ানো’, ‘বেড়াতে যাওয়া’। কিন্তু ‘বেরনো’, ‘বেরিয়ে পড়া’। ‘বেরিয়ে পড়লাম’ আর ‘বেড়িয়ে এসে জ্বরে পড়লাম’- দুটো বাক্যেরই প্রথম শব্দগুলি ভিন্ন।
- ‘আদেও’ বলে কোনও শব্দ নেই। শব্দটি ‘আদৌ’।
- বিদেশি শব্দে কোনও দীর্ঘস্বর থাকে না। জাপানি, ফরাসি, দেশি, তির, হিরে, বিদেশি, স্বদেশি, হিন্দি, আলমারি, বাহাদুরি, সরকারি প্রভৃতি।
- ‘আগামী’, কিন্তু ‘আগামিকাল’।
- ‘হক’ মানে অধিকার। ‘হোক’ একটি ক্রিয়া। ‘আমার হক বুঝে নেব’ আর ‘আমার করোনা হোক, বুঝে নেব’ – বানানে অর্থের আকাশপাতাল তফাত হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ‘তিনি আমার মামা হন’ – এখানে ‘হন’ মানে ‘হয়ে থাকেন’। কিন্তু, ‘গঙ্গায় স্নান করে পবিত্র হোন’- এর মানে বর্তমান কালে ‘হয়ে উঠুন’।
- শ্রেণি, প্রাণি, কোশ – এই তিনটি শব্দ এইরকম বানানে লেখা হয়।
- ‘কুল’ মানে বংশ, অথবা ইংরেজি শব্দটির লিখিত রূপ। কিন্তু ‘কূল’ মানে নদী, দিঘি বা সমুদ্রের পাড়। আবার ‘পাড়’ মানে তীরভূমি কিংবা শাড়ির পাড়, কিন্তু ‘পার’ হচ্ছে মূলত ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য। যদিও এখন কূল অর্থেও ‘পার’ ব্যবহার হয়।
- ‘ধারণা’। কিন্তু, ‘ধরন’।
- ‘মূলত’, ‘ক্রমশ’, ‘সাধারণত’ – এসবের পর আর বিসর্গ বসে না।
- কথ্য হালকা স্ল্যাং বা বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে শব্দ যথাসম্ভব সরল করে লেখা হয়। সেসব ক্ষেত্রে ণ্ড, ণ্ট বসে না। ন্ড, ন্ট বসে। যা ঢং করে বাজে তা ঘণ্টা। আর যা ষাট মিনিটে হয়, তা ঘন্টা। যা ঘাঁটা-র সমার্থক, তা ঘণ্ট। ‘মুণ্ড’, কিন্তু ‘মুন্ডু’। একই যুক্তিতে আরও কিছু বানান ভেদ আছে। যেহেতু তৎসম, তাই ‘কোণ’, ‘নীচ’, ‘রোগী’। কিন্তু যেহেতু কথ্য, তাই ‘কোনা’, ‘নিচু’, ‘রুগি’।
- ‘মরা’ মানে মরে যাওয়া। ‘মড়া’ মানে মৃতদেহ। মড়া হয়ে উঠতে গেলে মরা আবশ্যক।
- অভিধান দেখার ক্ষেত্রে অনেকেই আলাদা আলাদা নিয়ম মানেন। কিন্তু একটা নিয়ম সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অভিধানে কোনও শব্দের প্রথম যে বানান, সেটাই ওই বানানবিধিতে সর্বজনস্বীকৃত। তার পরের বানানগুলি হচ্ছে অঞ্চল বা উপভাষা-ভেদে প্রকার।
- উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে তুলে আনা উক্তির ক্ষেত্রে মূল বইয়ের বানান হুবহু এক রাখতে হবে। তা সে যতই প্রাচীন বানান হোক। এছাড়া কোনও সংলাপ থাকলে সে ক্ষেত্রে বানানে কিছু ছাড় দেওয়া চলে। একজন সমাজবিরোধী যদি বলে ‘মেসিন ঠেকিয়ে খালাস করে দেব’, সেখানে ‘মেশিন’ বানান ভুল হলেও রাখা যাবে। ওটা তার শ্রেণির চরিত্র বহন করে।
বেশিরভাগ বানানের ক্ষেত্রেই একটা না একটা যুক্তি থাকে। সেই যুক্তিটা একবার বুঝে গেলে বানান মুখস্থ করার আর প্রয়োজন পড়ে না। আপনিই মনে থেকে যায়। আশা করি ওপরে লেখা কথাগুলি পরবর্তীকালে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।
Visited 1300 times, 3 Visits today